তাজকিয়াহ (আরবি: تزكية) হল একটি আরবি-ইসলামিক পরিভাষা, সংক্ষেপে তাজকিয়া আল-নফস যার অর্থ "আত্মশুদ্ধি"।
এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে নফস (আত্ম-প্রবৃত্তি বা কামনা) কে প্রবৃত্তি-কেন্দ্রিক দশা থেকে পরিবর্তন করে শুদ্ধি ও আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণের দশায় নিয়ে যাওয়া হয়। এর ভিত্তি হল বিশুদ্ধ সুন্নত থেকে শরিয়াহ ও কর্ম অধ্যয়ন এবং নিজ কর্মে তার প্রয়োগ ঘটানো ও তার ফলশ্রুতিতে আল্লাহ সম্পর্কে আধ্যাত্মিক সচেতনতা লাভ করা (সর্বদা এই চেতনা নিয়ে থাকা যে, তিনি তার জ্ঞাতের দিক থেকে আমাদের সাথেই আছেন এবং আমরা যা কিছু করি তা জানেন, পাশাপাশি সর্বদা তার যিকির করা বা তাকে স্মরণ করা চিন্তা ও কর্মের মাধ্যমে), যাকে ইহসানের সর্বোচ্চ পর্যায় বলা হয়।
যে ব্যক্তি নিজেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে তাকে জাকি (আরবি: زكيّ) বলা হয়।
তাযকিয়া শুধু সচেতন শিক্ষা প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ করে না: বরঞ্চ এটি হল এমন কর্ম যা ন্যায়নিষ্ঠ জীবনাচরণ গঠন করে; এবং আল্লাহর সম্মুখে নিজের অবস্থানকে স্মরণ করার মাধ্যমে জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে কাজে লাগায়।
রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মহিমান্বিত মাস রমজান বিদায় হয়ে যাচ্ছে। শেকলবন্দী শয়তান মুক্ত হয়ে যাবে। শয়তান আমাদের নফসকে প্ররোচনা দেয়ার মিশনে সদা তৎপর হবে। তাই বলে কি আমরা হেরে যাবো?অবশ্যই না।
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা সর্বাধিক প্রচেষ্টা করব নফসকে পরিশুদ্ধ করার। পরিশুদ্ধির এ পথচলা এক দিনের নয়। তার জন্য আমাদের প্রতিনিয়ত চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। সূরাহ আল-বালাদে নিজের নফস তথা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াইকে বন্ধুর গিরিপথের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যে পথ উপরের দিকে গেছে। যেখানে পৌঁছাতে হলে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। অন্য দিকে গিরিপথের যে রাস্তাটি নিচের দিকে গেছে, সে পথে নামার জন্য কোনো পরিশ্রমের দরকার হয় না। এটি নিঃসন্দেহে ধ্বংস ও অনিষ্টের পথ। এখন সিদ্ধান্ত আমাদের, কোন পথে আমরা যাবো।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘আর আমরা ভালো ও মন্দ উভয় পথ তার জন্য সুস্পষ্ট করে দিয়েছি।’ (সূরা আল-বালাদ : ১০)
নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা কিছু কৌশল অবলম্বন করতে পারি।
১। আমাদের চলার পথে বিভিন্ন দোয়ার মাধ্যমে অবশ্যই আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে। এতে করে এ পথচলা অনেক সহজ হবে। রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর অধিকাংশ দোয়ায় বলতেন, “হে অন্তর পরিবর্তনকারী, আপনি আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের ওপর অটল রাখুন।’ (ইমাম তিরমিজি : ৩৫২২)
রাসূল সা:-এর আরেকটি খুব পছন্দের দোয়া হলো, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনারই রহমতের প্রত্যাশী। এক পলকের জন্যও আমাকে আমার ওপর ছেড়ে দেবেন না। আপনি আমার সব কাজ সুন্দর করে দিন। আপনি ছাড়া ইবাদতের যোগ্য আর কোনো মা’বুদ নেই।’ (আবু দাউদ : ৫০৯০, আহমাদ : ২০৪৩)
আমাদের উচিত দোয়া কবুলের উত্তম সময়গুলো বেছে নিয়ে ইখলাসসহ দোয়া করা। আল্লাহর হাতেই আত্মশুদ্ধির চাবিকাঠি। আল্লাহ বলেন, ‘বরং আল্লাহ তো যাকে ইচ্ছা পরিশুদ্ধ করেন।’ (সূরা আন নূর : ২১).
২। নফসকে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায় সফল হতে হলে অবশ্যই আমাদের তাকওয়া অর্থাৎ আল্লাহ ভীতি বৃদ্ধি করতে হবে। সবসময় নিজেকে এ কথা মনে করিয়ে দেয়া যে আল্লাহ আমাকে দেখছেন। ফেরেশতারা আমার ছোট-বড়, ভালো-মন্দ সব কাজ লিপিবদ্ধ করছেন। এই ভয় মনে থাকলে কুচিন্তা আত্মাকে দখল করতে পারবে না সহজেই।
তার পর পবিত্র কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে। অস্থির ভাবনাগুলো যখনই আসবে তখনই চেষ্টা করতে হবে কুরআন বুঝে পড়তে। তাফসিরসহ পড়া বেশ কার্যকরী। কুরআনে বর্ণিত জান্নাত জাহান্নামের কথা অবশ্যই চিন্তার উদ্রেক করবে।
আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মানুষ তোমাদের নিকট তোমাদের রবের পক্ষ থেকে এসেছে উপদেশও তোমাদের অন্তরে যা রয়েছে তার আরোগ্য।’ (সূরা আল ইউনুস : ৫৭)
আল্লাহ আরো বলেন,
‘যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে না ও কষ্টে পতিত হবে না।’ (সূরাহ ত্ব-হা :১২৩)
৩। বেশি বেশি ইস্তেগফার করা নাফসের পরিশুদ্ধির অন্যতম উপায়। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন,
‘বান্দা যখন কোনো গুনাহ করে তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে। পরে যখন সে গুনাহ থেকে বিরত থাকে এবং ইস্তেগফার করে এবং তাওবা করে তখন তার অন্তর উজ্জ্বল হয়।’ (ইমাম তিরমিজি : ৩৩৩৪)
৪। উত্তম বন্ধু নির্বাচন আত্ম নিয়ন্ত্রণে টাচস্টোনের মতো কাজ করে। এমন বন্ধু যারা আপনাকে আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দেবে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি সবর করে নিজেকে তাদের সাথেই রাখবে যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের রবকে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে। তুমি পার্থিব শোভা কামনা করে তাদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ো না। তুমি তার আনুগত্য করো না যার কলবকে আমি আমার স্মরণ থেকে অমনোযোগী করে দিয়েছি। যে তার নফসের গোলামি করে ও যার আমল হারিয়ে গেছে।’ (সূরা আল কাহাফ : ২৮)।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘নেককার ও বদকার বন্ধুর উদাহরণ হলো আতরওয়ালা ও কামারের মতো। মেশক বহনকারী হয় তোমাকে কিছু সুগন্ধি দেবে, অথবা তার কাছ থেকে সুবাস লাভ করবে। আর কামার হয় তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে অথবা তুমি তার কাছ থেকে দুর্গন্ধ পাবে।’ (ইমাম বুখারি : ৫৫৩৪, ইমাম মুসলিম : ২৬২৮)
৫। নফসের নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিদিন টার্গেট ঠিক করা উচিত। নির্দিষ্ট টার্গেটে পৌঁছাতে না পারলে নিজেকে ছোটখাটো শাস্তি দেয়া যেতে পারে। একটা বইয়ে পড়েছিলাম, সেখানে লেখক ফজর মিস হলে নিজেকে শাস্তি দেয়ার কৌশল বলেছিলেন। যেমন : বেশ ভালো পরিমাণ টাকা সাদাকা করা; যা প্রতিদিনের প্রয়োজন পূরণের জন্য বরাদ্দ। এতে শাস্তির কথা ভালোভাবে মনে থাকবে।
আরো একটি গল্প পড়েছিলাম অনেক আগে। যেখানে একটি নেককার ছেলে রাতের বেলা একটি বিপদগ্রস্ত মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছিল। তার মনে যথেষ্ট আল্লাহর ভয় থাকা সত্ত্বেও শয়তান তাকে বারবার কুমন্ত্রণা দিচ্ছিল মেয়েটার সান্নিধ্য পেতে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য চেষ্টা করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত না পেরে প্রদীপের আগুনে নিজের আঙুল দিয়ে রাখল। যাতে তার নফস জাহান্নামের শাস্তির ভয়াবহতা বুঝতে পারে। এভাবে সে সফলভাবে নফসকে হারাতে পেরেছিল। নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণের কী অভিনব উপযুক্ত পন্থা! আমরাও আমাদের নফসকে এ ধরনের লঘু দণ্ড দিয়ে সতর্ক করতে পারি!
৬। পরিশুদ্ধির নির্দিষ্ট টার্গেট পূরণ হলে নিজেকে পুরস্কৃত করা যেতে পারে! যা ভালো কাজের স্পৃহা আরো বাড়িয়ে দেবে। কোনো কোনো সালাফ যখন মিষ্টি খেতে ইচ্ছা করতেন, তখন নিজের সাথে অঙ্গীকার করতেন যে, আজ তাহাজ্জুদ পড়তে পারলে মিষ্টি খাবো। তার পর সফল হলে নিজেকে পুরস্কৃত করতেন।
৭। আত্মসমালোচনা করা নফসকে নিয়ন্ত্রণের একটি কার্যকর উপায়। ফিলিস্তিনের এক কিশোরের গল্প শুনেছিলাম। সে কিশোর শহিদ হওয়ার পরে তার পকেটে একটি ডায়েরি পাওয়া যায়। যাতে সে সারা দিন যা যা খারাপ কাজ করত তা লিখে রাখত। কত অসাধারণ পন্থা নিজেকে পরিশুদ্ধ করার। আল্লাহ তাকে কবুল করে নিন। এভাবে আমরাও লিখে রাখতে পারি। আমি নিশ্চিত পরের দিন আপনি আপনার আগের দিনের লিখে রাখা খারাপ কাজগুলো দেখলে লজ্জা পাবেন। একই কাজ আবার করতে দু’বার ভাববেন।
রাসূলুল্লাহ সা: নিচের দোয়াটি করতেন ‘হে আল্লাহ, আমাদের অন্তরে আপনার তাকওয়া সৃষ্টি করে দিন। তাকে পরিশুদ্ধ করে দিন। আপনিই তো সর্বোত্তম পরিশুদ্ধকারী। আপনিই তার অভিভাবক ও মাওলা।’ (মুসলিম :২৭২২)
দেখা যাচ্ছে যে ব্যক্তি মন্দ ও অকল্যাণকর কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করবে, সেই প্রকৃত অর্থে সফল হবে। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন।