ফিতনা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়:
1. বিপদ-মুসীবতের মাধ্যমে পরীক্ষা করা।
2. শাস্তি,
3. শিরক ও কুফরি,
4. নেফাক (মুনাফেকি)
5. বিভ্রান্ত করা।
6. হত্যা ও বন্দী।
7. মতানৈক্য
8. পাগলামি
9. আগুন দিয়ে জালিয়ে দেয়া।
১) বিপদ-মুসীবতের মাধ্যমে পরীক্ষা করা। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ
“মানুষ কি মনে করে যে, আমরা ঈমান এনেছি, একথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে অব্যাহতি দেয়া হবে?” (সূরা আনকাবূত- ২)
২) শাস্তি। আল্লাহ্ বলেন:
لِلَّذِينَ هَاجَرُوا مِنْ بَعْدِ مَا فُتِنُوا
“যারা নির্যাতিত হবার পর হিজরত করে...।” (সূরা নাহাল-১১০) আল্লাহ্ আরও বলেন:
يَوْمَ هُمْ عَلَى النَّارِ يُفْتَنُونَ
“সেদিন যখন তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে অগ্নিতে।” (সূরা যারিয়াত: ১৩)
৩) শিরক ও কুফরি। আল্লাহ বলেন:
حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ
“যে পর্যন্ত ফিতনা বা শিরক দূরীভূত না হয়।” (সূরা বাক্বারা- ১৯৩)
৪) নেফাক (মুনাফেকি)। আল্লাহ বলেন:
وَلَكِنَّكُمْ فَتَنْتُمْ أَنْفُسَكُمْ
“কিন্তু তোমরা (মুনাফেকির মাধ্যমে) নিজেদেরকে বিপদগ্রস্ত করেছো।” (সূরা হাদীদ: ১৪)
৫) বিভ্রান্ত করা। আল্লাহ্ বলেন:
وَمَنْ يُرِدْ اللَّهُ فِتْنَتَهُ
“আর আল্লাহ্ যাকে বিভ্রান্ত করার ইচ্ছা করেন।” (সূরা মায়েদাহ: ৪১)
৬) হত্যা ও বন্দী। আল্লাহ্ বলেন:
إِنْ خِفْتُمْ أَنْ يَفْتِنَكُمْ الَّذِينَ كَفَرُوا
“যদি তোমরা ভয় কর যে, কাফেরগণ তোমাদেরকে হত্যা বা বন্দী করবে।” (সূরা নিসা: ১০১)
৭) মতানৈক্য। আল্লাহ্ বলেন:
وَلَأَوْضَعُوا خِلَالَكُمْ يَبْغُونَكُمْ الْفِتْنَةَ
“আর তারা তোমাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে দৌড়াদৌড়ি করে ফিরত।” (সূরা তওবা- ৪৭)
৮) পাগলামি। আল্লাহ্ বলেন:
بِأَيِّيكُمْ الْمَفْتُونُ
“তোমাদের মধ্যে কে বিকারগ্রস্ত।” (সূরা কলম- ৬)
৯) আগুন দিয়ে জালিয়ে দেয়া। আল্লাহ্ বলেন:
إِنَّ الَّذِينَ فَتَنُوا الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَتُوبُوا
“নিশ্চয় যারা মু’মিন নর-নারীকে (আগুনে জ্বালিয়ে) বিপদাপন্ন করেছে এবং পরে তওবা করে নি।” (সূরা বুরূজ- ১০)
১০) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা: আল্লাহ্ তা’আলা বান্দাদেরকে বিভিন্ন ফিতনার মধ্যে নিমজ্জিত করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন। তিনি এরশাদ করেন:
وَنَبْلُوكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ
“আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা বিশেষভাবে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।” (সূরা আম্বিয়া- ৩৫)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “চাটাইয়ের কাঠিগুলো যেমন একটি একটি করে সাজানো হয়, তেমনি অন্তরের মধ্যে একটি একটি একটি করে ফিতনা পতিত হয়। যে অন্তর তা গ্রহণ করবে তার মধ্যে একটি কাল দাগ পড়ে যাবে। আর যে অন্তর তাকে প্রত্যাখ্যান করবে তার মধ্যে একটি শুভ্র দাগ পড়বে। এভাবে অন্তরগুলো দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি সাদা পাথরের মত শুভ্র। তাকে ফিতনাই কোন ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না। আর একটি অন্তর ছাইয়ের মত কাল। যেমন কোন পানির পাত্রকে উপুড় করে রাখা হয় (সে পাত্র যেমন পানি ধরে রাখে না, তেমনি উক্ত অন্তর) কোন ভাল কাজ চেনে না কোন অন্যায়কে অন্যায় মনে করে না। শুধু সে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে থাকে।” (সহীহ মুসলিম) এধরণের ফিতনা কখনো জাতির জন্য শাস্তি স্বরূপ এসে থাকে, আবার কারো জন্য রহমত ও পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ এসে থাকে।
আল্লাহ যে সমস্ত ফিতনার মাধ্যমে বান্দাদেরকে পরীক্ষা করে থাকেন তা অনেক ধরণের। আর তা দু’টি প্রকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ:
ক) খাহেশাত ও প্রবৃত্তির ফিতনা। যেমন সম্পদ ও নারীর ফিতনা।
খ) সংশয়-সন্দেহের ফিতনা। যেমন ঐ সমস্ত প্রবৃত্তি যার ফলে বিভিন্ন বিদআ’তের উৎপত্তি হয়েছে,
মুসলিমদের মাঝে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, তারা বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়েছে।
ইসলামে ব্যাপক ফিতনা এবং বিশেষ ফিতনা সম্পর্কে অনেক আলোচনা এসেছে। যার উদ্দেশ্য হল সব ধরণের ফিতনা থেকে মানুষকে সতর্ক করা।
কয়েকটি ফিতনা যেমন: নারীর ফিতনা, সম্পদের ফিতনা, দুনিয়ার ফিতনা, জীবনের ফিতনা, মৃত্যুর ফিতনা
তাছাড়াও এমন কিছু ফিতনার কথাও আলোচনা হয়েছে যা শেষ যুগে প্রকাশ লাভ করবে।
যেমন: ‘দুহাইমা’ নামক ফিতনা, ‘আহ্লাস’ নামক ফিতনা, দাজ্জালের ফিতনা, সমস্ত মানুষ দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার ফিতনা, শেষ যুগে কুফরি ও শিরকের ব্যাপক ফিতনা, মুসলিমদের মাঝে পরষ্পারিক কোন্দল ও যুদ্ধের ফিতনা ইত্যাদি।
ফিতনার অনেক কারণ আছে। যেমন:
১) প্রবৃত্তির অনুসরণ ও অসৎ উদ্দেশ্য।
আল্লাহ্ বলেন:
يَادَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعْ الْهَوَى فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ
“হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব তুমি মানুষের মাঝে সুবিচার কর এবং খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না, কেননা এটা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করবে।” (সূরা ছোয়াদ- ২৬) সুতরাং প্রবৃত্তি মানুষকে অন্ধ ও বধির করে দেয়। তার সামনে সত্যকে বাতিল হিসেবে উপস্থাপন করে আর বাতিলকে সত্যরূপে দেখিয়ে থাকে।
২) বাড়াবাড়ি।
দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ি হল ফিতনায় পতিত হওয়ার অন্যতম একটি বড় কারণ। কেননা খারেজীগণ শুধু বাড়াবাড়ির কারণেই বিদআতে লিপ্ত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “তোমরা অতিরঞ্জন থেকে সাবধান! কেননা অতিরঞ্জন তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করেছে। বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে তারা পরস্পরকে খুন করেছে এবং হারামকে হালাল করে নিয়েছে।“ (ইবনে মাজাহ ও হাকিম)
এমনিভাবে বাড়াবাড়ির বিপরীতে দ্বীনের বিষয়ে শিথিলতা দেখাতে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে মুর্জিয়া মতবাদের ফিতনা।
৩) অস্পষ্ট বিষয়ের অনুসরণ এবং সুস্পষ্ট বিষয় পরিত্যাগ।
আল্লাহ বলেন:
فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا
“অতএব যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে, ফলত: তারাই ফিতনা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে অস্পষ্টের অনুসরণ করে। অথচ আল্লাহ ব্যতীত তার অর্থ কেউই অবগত নয়; আর যারা জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত, তারা বলে: আমরা তাতে বিশ্বাস করি, সমস্তই আমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে সমাগত।“ (সূরা আল ইমরান: ৭)
৪) অজ্ঞতা।
শরীয়ত তথা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছেন সে সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ:) বলেন: ‘বিভিন্ন স্থান এবং বিভিন্ন যুগে রিসালাতের বাণী বিভিন্ন কারণে গোপন ও অস্পষ্ট থেকে। যে কারণে মানুষ রিসালাত থেকে অজ্ঞ থেকে যায়। কখনো আসল শব্দ (মূল কথা) সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যায়, কখনো শব্দটি জানলেও তার প্রকৃত অর্থ বুঝে না। আর তখনই তারা নবুওতের আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে জাহেলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। আর এ কারণেই মানুষ লিপ্ত হয়েছে শিরকে, বিভক্ত করে নিয়েছে দ্বীনকে বিভিন্ন দল ও উপদলে। তাই কথা ও কাজের মাধ্যমে সংঘটিত ফিতনা সমূহ অজ্ঞতারই অন্তর্ভুক্ত। আর তার কারণ হল নবুওতের আলো গোপন থাকা, রেসালাতের হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হওয়া।’
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সব ধরণের ফিতনা থেকে উম্মতকে সতর্ক করেছেন, আর পথ দেখিয়েছেন ফিতনার সময় সে কিভাবে তা থেকে মুক্তি লাভ করবে। বর্ণনা করেছেন সে সময় মুসলিম ব্যক্তি করণীয় কি। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ:
১) ফিতনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা।
আর তা প্রত্যেক সালাতের মধ্যে। আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “যখন তোমরা শেষ বৈঠকের তাশাহুদ পাঠ করবে তখন আল্লাহর কাছে চারটি বিষয় থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে: ক) জাহান্নামের আযাব থেকে খ) কবরের আযাব থেকে গ) জীবন-মৃত্যুর ফিতনা থেকে এবং ঘ) মাসীহ দাজ্জালের অনিষ্ট থেকে। (সহীহ মুসলিম)
২) কুরআন এবং সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা।
কেননা এদু’টিকে আঁকড়ে ধরে থাকলে বান্দা আক্বীদা ও আমলের বিভ্রান্তি ও বক্রতা থেকে বেঁচে থাকতে পারবে। কোন ফিতনায় পতিত হবে না। যে ব্যক্তি কুরআন-সুন্নাহ আঁকড়ে থাকবে এবং নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হেদায়েতের উপর জীবন পরিচালনা করবে, দা’ওয়াতী কাজ করবে, সৎকাজের আদেশ দিবে, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে- সে যাবতীয় ফিতনা থেকে পরিত্রাণ পাবে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হেদায়েতের বিরোধিতা করা বা তা থেকে বিচ্যুত হওয়াই তো হল আসল ফিতনা।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنْ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقَى
“পরে আমার পক্ষ হতে তোমাদের নিকট সৎপথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ-কষ্ট পাবে না।” (সূরা ত্বাহা- ১২৩)
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “আমি তোমাদেরকে ওসীয়ত করছি আল্লাহ ভীতির, নেতার কথা শোনা ও মানার, যদিও সে হাবশি ক্রীতদাস হয়। কেননা তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি দীর্ঘ জীবন লাভ করবে সে অচিরেই অনেক ধরণের দেখতে পাবে। তোমরা নব উদ্ঘাটিত বিষয় (বিদআত) থেকে সাবধান! কেননা তা পথভ্রষ্টতা। তোমাদের মধ্যে যারা উক্ত (মতানৈক্যের) যুগ পাবে, তাদের উপর আবশ্যক হল, তারা আমার সুন্নাত এবং সুপথ প্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে। উহা দাঁত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরবে (অর্থাৎ দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে)।” (তিরমিযী)
৩) যখন ফিতনা দেখা দেবে তখন মুসলিমদের জামায়াত এবং তাদের ইমাম (নেতা)কে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা।
যদি মুসলিমদের জামায়াত না থাকে এবং তাদের ইমামও না থাকে, তবে সে সময় সমস্ত দল (পথভ্রষ্ট ফেরকা সমূহ) থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া। হুযায়ফা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মানুষ রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে কল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতো, আর আমি তাঁকে অকল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম, এই ভয়ে যে আমি হয়তো তাতে পতিত হয়ে যাব। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা পূর্বে (কুফরির) অজ্ঞতা ও অমঙ্গলের মধ্যে ছিলাম। অত:পর আল্লাহ আমাদেরকে (হেদায়েতের) এই কল্যাণ দান করলেন। এই কল্যাণের পর কি কোন অকল্যাণ সংঘটিত হবে? তিনি বললেন: হ্যাঁ হবে। আমি বললাম, উক্ত অকল্যাণের পর কি কোন কল্যাণ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ আছে। তবে তা ধুঁয়া-মুক্ত (নির্ভেজাল) হবে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সে ধুঁয়া কিরূপ? তিনি বললেন, একদল লোক এমন হবে, যারা আমার হেদায়েতের পথ ছেড়ে অন্য পথ গ্রহণ করবে। তাদের মধ্যে ভাল-মন্দ উভয়ই তুমি প্রত্যক্ষ করবে। আমি প্রশ্ন করলাম, উক্ত কল্যাণের পর কি আর কোন অকল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ আসবে। এদকল লোক এমন হবে যারা জাহান্নামের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মানুষকে আহবান করবে (অর্থাৎ- জাহান্নাম আবশ্যক করে এমন বিষয়ের প্রতি দা’ওয়াত দিবে)। যেই তাদের ডাকে সাড়া দিবে তাকেই জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে তাদের পরিচয় জানিয়ে দিন! তিনি বললেন, তারা এমন লোক যারা আমাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে এবং আমাদের ভাষাতেই কথা বলবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এধরণের অকল্যাণের যুগে যদি আমি পৌঁছে যাই, সে অবস্থায় আমার করণীয় সম্পর্কে আপনি আমাকে কি নির্দেশ দিচ্ছেন? তিনি বললেন, মুসলমানদের জামায়াত এবং তাদের ইমামকে আঁকড়ে থাকবে। আমি প্রশ্ন করলাম, যদি তাদের কোন জামায়াত না থাকে এবং ইমামও না থাকে? তিনি বললেন, তখন ঐ-সমস্ত (পথভ্রষ্ট) দলের সবগুলোকে পরিত্যাগ করবে। যদিও গাছের একটি শিকড়কে কামড়ে ধরে থাকতে হয় (অর্থাৎ উক্ত সময়ের দুঃখ-কষ্টের উপর ধৈর্য ধারণ করবে)। আর মৃত্যু আসা পর্যন্ত তুমি ঐ অবস্থাতেই থাকবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
৪) মুসলিম শাসকদের অত্যাচারের উপর ধৈর্য ধারণ করা।
তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা। কিন্তু যদি তাদের থেকে প্রকাশ্য কুফরি পাওয়া যায় তবে সে কথা ভিন্ন। (অর্থাৎ শর্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে।)
উবাদা বিন সামেত (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
دَعَانَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَبَايَعْنَاهُ فَكَانَ فِيمَا أَخَذَ عَلَيْنَا أَنْ بَايَعَنَا عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِي مَنْشَطِنَا وَمَكْرَهِنَا وَعُسْرِنَا وَيُسْرِنَا وَأَثَرَةٍ عَلَيْنَا وَأَنْ لَا نُنَازِعَ الْأَمْرَ أَهْلَهُ قَالَ إِلَّا أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِنْ اللَّهِ فِيهِ بُرْهَانٌ
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে ইসলামের পথে আহবান করলেন, আমরাও তাঁর কাছে বায়আত করলাম। তিনি বলেন, আমাদের কাছে যে সমস্ত বিষয়ের উপর তিনি বায়আত নিলেন তা হল, আমরা যেন সুখের ও দুঃখের অবস্থায়, সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় এবং আমাদের উপর অন্যদের প্রাধান্য দেয়ার (স্বার্থ-হানীর) ক্ষেত্রেও যেন নেতার কথা শুনি ও তার আনুগত্য করি এবং শাসকের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবো না। যতক্ষণ তোমরা তার থেকে সুস্পষ্ট কুফরি দেখতে না পাও যে ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে (কুরআন-সুন্নাহতে) তোমাদের জন্য স্বচ্ছ দলীল রয়েছে ততক্ষণ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না।” (বুখারী) আর ব্যাপকভাবে সবক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করবে। কেননা আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنْ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنْ الْأَمْوَالِ وَالْأَنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرْ الصَّابِرِينَ الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ
“এবং নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা এবং ধন ও প্রাণ এবং ফল-ফসলের অভাবের দ্বারা; এবং ঐসব ধৈর্যশীলকে সুসংবাদ প্রদান কর। যাদের উপর কোন বিপদ আপতিত হলে তারা বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহরই জন্যে এবং নিশ্চয় আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।” (সূরা বাক্বারাঃ ১৫৫-১৫৬)
৫) ফিতনায় না জড়িয়ে তা থেকে যে কোনভাবে দূরে থাকার চেষ্টা করা।
মানুষ ফিতনা থেকে যত দূরে থাকতে পারবে ততই সে ফিতনায় নিমজ্জিত ব্যক্তির চেয়ে অধিক নিরাপদে থাকবে। আবু বাকরা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
“নিশ্চয় অচিরেই অনেক ধরণের পাপাচারের ফিতনা দেখা দিবে। সে সময় ফিতনা থেকে বসে থাকা ব্যক্তি তা নিয়ে দাঁড়ানো ব্যক্তি অপেক্ষা নিরাপদে থাকবে। আর দাঁড়ানো ব্যক্তি তা নিয়ে চলমান ব্যক্তি থেকে ভাল থাকবে। আর চলমান ব্যক্তি সে ব্যাপারে দ্রুতগামী থেকে ভাল থাকবে। (অর্থাৎ এদের প্রত্যেকেই একে অপর থেকে ভয়ানক অবস্থায় পতিত হবে। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক অবস্থায় সেই ব্যক্তি, যে ফিতনার ব্যাপারে দ্রুতগামী, সে-ই তা উসকিয়ে দেয়। তারপর হল সে ব্যক্তি যে তার উপকরণ নিয়ে তৎপর থাকে। তারপর হল সে ব্যক্তি যে ফিতনা থেকে বসে থাকে তাতে সরাসরি লিপ্ত হয় না তবে তাকে সমর্থন করে।) যদি এরকম ফিতনা শুরু হয়ে যায়, তখন যার উট আছে সে যেন উটের রাখালিতে মগ্ন হয়, যার ছাগল আছে সে যেন ছাগলের রাখালিতে মগ্ন হয়, যার ক্ষেত-খামার আছে সে যেন চাষাবাদের কাজে ব্যস্ত থাকে।
এক লোক প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! করো যদি উট বা ছাগল বা ক্ষেত-খামার না থাকে, তখন সে কি করবে? তিনি বললেন: সে নিজের তরবারি নিয়ে তা ভোঁতা করে ফেলবে। তারপর ফিতনা থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব হলে মুক্ত থাকবে। হে আল্লাহ আমি কি পৌঁছিয়েছি? হে আল্লাহ আমি কি পৌঁছিয়েছি? হে আল্লাহ আমি কি পৌঁছিয়েছি?
বর্ণনাকারী বলেন: সে সময় জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে যদি বাধ্য করে দু’দলের কোন এক দলে নিয়ে যাওয়া হয়? এমতাবস্থায় কোন লোক তরবারি দিয়ে আমাকে আঘাত করে অথবা কোন তীর এসে আমাকে হত্যা করে ফেলে? তিনি বললেন, হত্যাকারী তার নিজের এবং তোমার পাপসমূহ বহন করবে এবং জাহান্নাম-বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সহীহ মুসলিম)
৬) অধিক হারে তওবা ইস্তেগফার ও তাসবীহ-তাহলীল করা।
আল্লাহ তা’আলা বলেন:
فَلَوْلَا أَنَّهُ كَانَ مِنْ الْمُسَبِّحِينَ لَلَبِثَ فِي بَطْنِهِ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ
“তিনি (ইউনুস আ:) যদি অধিকহারে তা সবীহ পাঠকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হতেন, তবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত মাছের পেটেই রয়ে যেতেন।” (সূরা সাফফাত- ১৪৩-১৪৪) বিপদাপদ নাযিল হয় শুধু পাপাচারের কারণে। আর বিপদাপদ থেকে মুক্তি দেয়া হয়, একমাত্র তওবার মাধ্যমে।
৭) অধিক হারে ইবাদত ও সট আমল করা।
কেননা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “যখন মানুষ বিবাদ-বিসম্বাদে (খুন-খারাবীতে) লিপ্ত হবে তখন তা থেকে বিরত থেকে ইবাদতে লিপ্ত হওয়া, আমার নিকট হিজরত করে চলে আসার মত পুণ্যের কাজ।” (মুসলিম, আহমাদ ও তিরমিযী) সুতরাং সবধরনের ইবাদতের প্রতি বিশেষ যত্নবান হবে। ইবাদত আত্মাকে সুস্থির করে এবং মানুষকে সঠিক চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ দেয়।
৮) ধীর স্থিরতা অবলম্বন।
সবরের মাধ্যমে ধীর স্থিরতা লাভ করা যায়। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “নিশ্চয় তোমার মধ্যে দু’টি গুণ আছে যা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল পসন্দ করেন। আর তা হল: ধৈর্য ও ধীর স্থিরতা।” (মুসলিম ও তিরমিযী)
৯) পূর্বলক্ষণ শুভ মনে করা এবং আল্লাহর সাহায্যের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা রাখা।
যেমনটি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খন্দক যুদ্ধে খন্দক খনন করার সময় সাহাবীদেরকে বিভিন্ন বিজয়ের সুসংবাদ দিচ্ছিলেন।
১০) উদ্ভূত সমস্যার সম্ভাব্য সমাধানের প্রচেষ্টা করা।
নিরাশ না হওয়া এবং বিষয়টিকে সে অবস্থাতেই ছেড়ে না দেয়া। যেমনটি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হুনায়ন যুদ্ধের ক্ষেত্রে করেছিলেন- পরিস্থিতিযখন যুদ্ধের পরিস্থিতি কঠিন হয়ে গিয়েছিল। তিনি ছেড়ে দেননি, সাধ্যানুযায়ী পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছেন। অন্যথায় মুসলিমদের পরাজয় ঘটতো।
১১) ফিতনার সময় ইসলামী ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা বাস্তবায়ন করা।
বিশেষ করে মুসলিমদের উপর কাফেরদের পক্ষ থেকে আক্রমণ আসলে। এটি একটি আক্বীদাহ সংক্রান্ত বিষয়, যার মাধ্যমে ‘ওয়ালা ও বারা’ (মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্ব এবং কাফেরদের সাথে শত্রুতা) সুস্পষ্ট হয়।
১২) অপপ্রচার থেকে সাবধান থাকবে এবং যে কোন সংবাদ পরিবেশন করার সময় সাবধানতা অবলম্বন করবে এবং তা যাচাই-বাছাই করে নিবে।
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কাছে যদি পাপাচারী কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তা পরীক্ষা করে দেখবে। যাতে অজ্ঞতা বশত: তোমরা কোন সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত না কর, এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও।“ (সূরা হুজুরাত-৬)
মিডিয়া তথা প্রচার মাধ্যমের যুদ্ধ অনেক সময় বাস্তব যুদ্ধের চেয়ে অধিক প্রভাব সৃষ্টি করে। যেমনটি ঘটেছিল মুসলিম মুহাজিরদের ক্ষেত্রে যখন তারা মিথ্যা প্রচারের কারণে হাবশা থেকে ফেরত এসেছিলেন। যেমনটি ঘটেছিল ইফকের ঘটনায় অপপ্রচারের মাধ্যমে।
১৩) বিপদ-মুসীবত নাযিল হওয়ার সময় বেশী করে দু’আ করা এবং কুনূতে নাযেলা পাঠ করা।
১৪) ফিতনা সম্পর্কিত হাদিছগুলোকে চলমান পরিস্থিতির সাথে না মিলানো।
এটা মিলানোর কাজ হল নির্ভরযোগ্য আলেমদের। কেননা এর মাধ্যমে হাদিছকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়।
১৫) স্বপ্নের উপর নির্ভর করা থেকে সতর্ক থাকা।
কেননা কিছু লোক স্বপ্নের মাধ্যমে বিভিন্ন কর্ম পদ্ধতি নির্ধারণ করে থাকে। আর এটা হল সূফীদের নীতি। কিন্তু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের নীতি হল শরীয়তের দলীলের ভিত্তিতে কর্ম পদ্ধতি নির্ধারণ করা।
১৬) আল্লাহ-ভীরু আলেম-ওলামাদের সাথে বিশেষ সম্পর্ক রাখা।
যারা সর্বদা হক্ব কথা বলেন এবং আল্লাহর কথা বলতে ও তাঁর পথে চলতে কাউকে পরওয়া করেন না।