লাইলাতুল কদর (আরবি: لیلة القدر) এর অর্থ অতিশয় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত বা পবিত্র রজনী। আরবি ভাষায় ‘লাইলাতুল’ অর্থ হলো রাত্রি বা রজনী এবং ‘কদর’ শব্দের অর্থ সম্মান, মর্যাদা, মহাসম্মান। এ ছাড়া এর অন্য অর্থ হলো—ভাগ্য, পরিমাণ ও তাকদির নির্ধারণ করা।
ইসলাম ধর্ম অনুসারে, এ রাতে ইসলামের মহানবী, মুহাম্মদের অনুসারীদের সম্মান বৃদ্ধি করা হয় এবং মানবজাতির ভাগ্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়। তাই মুসলমানদের কাছে এই রাত অত্যন্ত পুণ্যময় ও মহাসম্মানিত হিসেবে পরিগণিত। কুরানের বর্ণনা অনুসারে, আল্লাহ এই রাত্রিকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন এবং এই একটি মাত্র রজনীর উপাসনা হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক সওয়াব অর্জিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর মাহে রমজানে এই মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল কদর মুসলিমদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে বলে তারা বিশ্বাস করে.
পবিত্র কুরআনে ‘কদর’ নামে স্বতন্ত্র একটি সূরা নাজিল করে আল্লাহ তায়ালা শবে-কদরের গুরুত্ব অল্প কথায় বুঝিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন আমি একে নাজিল করেছি শবে-কদর। শবে-কদর সম্বন্ধে আপনি কি জানেন? শবে-কদর হলো হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতাগণ ও রুহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশে। এটা নিরাপত্তা- যা ফজর উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
সূরা কাদর
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
1
আমি একে নাযিল করেছি শবে-কদরে।
BEHOLD, from on high have We bestowed this [divine writ] on Night of Destiny.
إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ
2
শবে-কদর সমন্ধে আপনি কি জানেন?
And what could make thee conceive what it is, that Night of Destiny?
وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ
3
শবে-কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
The Night of Destiny is better than a thousand months:
لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ
4
এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে।
in hosts descend in it the angels, bearing divine inspiration by their Sustainer's leave; from all [evil] that may happen
تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍ
5
এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
does it make secure, until the rise of dawn.
سَلَامٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطْلَعِ الْفَجْرِ
হাদিস অনুযায়ী, ২০ রমজানের পর যেকোনো বিজোড় রাতে কদর হতে পারে। তবে ২৬ রমজান দিবাগত রাতেই লাইলাতুল কদর আসে বলে আলেমদের অভিমত। আয়েশা থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে, মুহাম্মদ রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা রমজানের শেষ ১০ রাতে শবে কদর সন্ধান করো। (বুখারি ও মুসলিম) আরেকটি হাদিসে মুহাম্মদ বলেছেন, মাহে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে তোমরা শবে কদর সন্ধান করো। (সহীহ বুখারী)
ইমাম আবূ মুহাম্মদ ইবনে আবী হাতিম (র) এই সূরার তাফসীর প্রসঙ্গে একটি বিস্ময়কর রিওয়াইয়াত আনয়ন করেছেন। হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, সপ্তম আকাশের শেষ সীমায় জান্নাতের সাথে সংযুক্ত রয়েছে সিদরাতুল মুনতাহা, যা দুনিয়া ও আখিরাতের দূরত্বের উপর অবস্থিত। এর উচ্চতা জান্নাতে এবং এর শিকড় ও শাখা প্রশাখাগুলো কুরসীর নিচে প্রসারিত। তাতে এতো ফেরেশতা অবস্থান করেন যে, তাদের সংখ্যা নির্ণয় করা আল্লাহ পাক ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এমন কি চুল পরিমাণও জায়গা নেই যেখানে ফেরেশতা নেই। ঐ বৃক্ষের মধ্যভাগে হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম অবস্থান করেন।
আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হযরত জিবরাঈল আলাইহি সালামকে ডাক দিয়ে বলা হয়, “হে জিবরাঈল (আ) কদরের রাত্রিতে সমস্ত ফেরেশতাকে নিয়ে পৃথিবীতে চলে যাও।” এই ফেরেশতাদের সবারই অন্তর স্নেহ ও দয়ায় ভরপুর। প্রত্যকে মুমিনের জন্যে তাঁদের মনে অনুগ্রহের প্রেরণা রয়েছে। সূর্যাস্তের সাথে সাথেই কদরের রাত্রিতে এসব ফেরেশতা হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম এর সাথে নেমে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েন এবং সব জায়গায় সিজদায় পড়ে যান। তাঁরা সকল ঈমানদার নারী পুরুষের জন্য দুয়া করেন। কিন্তু তাঁরা গীর্জায় মন্দিরে, অগ্নিপূজার জায়গায়, মূর্তিপূজার জায়গায়, আবর্জনা ফেলার জায়গায়, নেশা খোরের অবস্থান স্থলে, নেশাজাত দ্রব্যাদি রাখার জায়গায়, মূর্তি রাখার জায়গায়, গান বাজনার সাজ সরঞ্জাম রাখার জায়গায় এবং প্রস্রাব পায়খানার জায়গায় গমন করেন না। বাকি সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে তাঁরা ঈমানদার নারী পুরুষের জন্যে দুয়া করে থাকেন। হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম সকল ঈমানদারের সাথে করমর্দন করেন। তাঁর করমর্দনের সময় মুমিন ব্যক্তির শরীরের লোমকূপ খাড়া হয়ে যায়, মন নরম হয় এবং অশ্রুধারা নেমে আসে। এসব নিদর্শন দেখা দিলে বুঝতে হবে তার হাত হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম এর হাতের মধ্যে রয়েছে।
হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, ঐ রাত্রে যে ব্যক্তি তিনবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করে, তার প্রথমবারের পাঠের সাথে সাথেই সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়, দ্বিতীয়বার পড়ার সাথে সাথেই আগুন থেকে মুক্তি পেয়ে যায় এবং তৃতীয়বারের পাঠের সাথে সাথেই জান্নাতে প্রবেশ সুনিশ্চিত হয়ে যায়। বর্ণনাকারী বলেন; হে আবু ইসহাক (র) ! যে ব্যক্তি সত্য বিশ্বাসের সাথে এ কালেমা উচ্চারণ করে তার কি হয়? জবাবে তিনি বলেন; সত্য বিশ্বাসীর মুখ হতেই তো এ কালেমা উচ্চারিত হবে। যে আল্লাহর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ ! লায়লাতুল কাদর কাফির ও মুনাফিকদের উপর এতো ভারী বোধ হয় যে, যেন তাদের পিঠে পাহাড় পতিত হয়েছে। ফজর পর্যন্ত ফেরেশতারা এভাবে রাত্রি কাটিয়ে দেন।
তারপর হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম উপরের দিকে উঠে যান এবং অনেক উপরে উঠে স্বীয় পালক ছড়িয়ে দেন। অতঃপর তিনি সেই বিশেষ দুটি সবুজ পালক প্রসারিত করেন যা অন্য কোন সময় প্রসারিত করেন না। এর ফলে সূর্যের কিরণ মলিম ও স্তিমিত হয়ে যায়। তারপর তিনি সমস্ত ফেরেশতাকে ডাক দিয়ে নিয়ে যান। সব ফেরেশতা উপরে উঠে গেলে তাদের নূর এবং হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম এর পালকের নূর মিলিত হয়ে সূর্যের কিরণকে নিষ্প্রভ করে দেয়। ঐ দিন সূর্য অবাক হয়ে যায়। সমস্ত ফেরেশতা সেদিন আকাশ ও জমীনের মধ্যবর্তী স্থানের ঈমানদার নারী পুরুষের জন্য রহমত কামনা করে তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। তাঁরা ঐ সকল লোকের জন্যেও দুয়া করেন যারা সৎ নিয়তে রোযা রাখে এবং সুযোগ পেলে পরবর্তী রমযান মাসেও আল্লাহর ইবাদত করার মনোভাব পোষণ করে।
সন্ধ্যায় সবাই প্রথম আসমানে পৌঁছে যান। সেখানে অবস্থানকারী ফেরেশতারা এসে তখন পৃথিবীতে অবস্থানকারী ঈমানদারদের অমুকের পুত্র অমুক, অমুকের কন্যা অমুক, বলে বলে খবরাখবর জিজ্ঞেস করেন। নির্দিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার পর কোন কোন ব্যক্তি সম্পর্কে ফেরেশতারা বলেন; তাকে আমরা গত বছর ইবাদতে লিপ্ত দেখেছিলাম, কিন্তু এবার সে বিদআতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। আবার অমুককে গত বছর বিদআতে লিপ্ত দেখেছিলাম, কিন্তু এবার তাকে ইবাদতে লিপ্ত দেখে এসেছি।
প্রশ্নকারী ফেরেশতা তখন শেষোক্ত ব্যক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে মাগফিরাত, রহমতের দুয়া করেন। ফেরেশতারা প্রশ্নকারী ফেরেশতাদেরকে আরো জানান যে, তাঁরা অমুক অমুককে আল্লাহর যিকর করতে দেখেছেন, অমুক অমুককে রুকূতে, অমুক অমুককে সিজদায় পেয়েছেন। এবং অমুক অমুককে কুরআন তিলাওয়াত করতে দেখেছেন। একরাত একদিন প্রথম আসমানে কাটিয়ে তাঁরা দ্বিতীয় আসমানে গমন করেন। সেখানেই একই অবস্থার সৃষ্টি হয়। এমনি করে তাঁরা নিজেদের জায়গা সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে পৌঁছেন। সিদরাতুল মুনতাহা তাঁদেরকে বলেঃ আমাতে অবস্থানকারী হিসেবে তোমাদের প্রতি আমাদের দাবী রয়েছে। আল্লাহকে যারা ভালোবাসে আমিও তাদেরকে ভালবাসি। আমাকে তাদের অবস্থার কথা একটু শোনাও, তাদের নাম শোনাও।
হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন; ফেরেশতারা তখন আল্লাহর পূণ্যবান বান্দাদের নাম ও পিতার নাম জানাতে শুরু করেন। তারপর জান্নাত সিদরাতুল মুনতাহাকে সম্বোধন করে বলে; তোমাতে অবস্থানকারীরা তোমাকে যে সব খবর শুনিয়েছে সেসব আমাকেও একটু শোনাও। তখন সিদরাতুল মুনতাহা জান্নাতকে সব কথা শুনিয়ে দেয়। শোনার পর জান্নাত বলে ; অমুক পুরুষ ও নারীর উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। হে আল্লাহ ! অতি শীঘ্রই তাদেরকে আমার সাথে মিলিত করুন।
হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম সর্বপ্রথম নিজের জায়গায় পৌঁছে যান। তাঁর উপর তখন ইলহাম হয় এবং তিনি বলেন; হে আল্লাহ ! আমি আপনার অমুক অমুক বান্দাকে সিজদারত অবস্থায় দেখেছি। আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। আল্লাহ তায়ালা তখন বলেনঃ আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম তখন আরশ বহনকারী ফেরেশতাদরকে এ কথা শুনিয়ে দেন। তখন ফেরেশতারা পরস্পর বলাবলি করেন যে, অমুক অমুক নারী পুরুষের উপর আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত হয়েছে। তারপর হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম বলেন; হে আল্লাহ ! গত বছর আমি অমুক অমুক ব্যক্তিতে সুন্নাতের উপর আমলকারী এবং আপনার ইবাদতকারী হিসেবে দেখেছি কিন্তু এবার সে বিদআতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে এবং আপনার বিধি বিধানের অবাধ্যতা করেছে। তখন আল্লাহ তাবারাক ওয়া তা’য়ালা বলেনঃ হে জিবরাঈল (আ) ! সে যদি মৃত্যুর তিন মিনিট পূর্বেও তাওবা করে নেয় তাহলে আমি তাকে মাফ করে দেবো। হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম তখন হঠাৎ করে বলেনঃ হে আল্লাহ ! আপনারই জন্যে সমস্ত প্রশংসা। আপনি সমস্ত প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। হে আমার প্রতিপালক ! আপনি আপনার সৃষ্ট জীবের উপর সবচেয়ে বড় মেহেরবান। বান্দা তার নিজের উপর যেরূপ মেহেরবানী করে থাকে আপনার মেহেরবানী তাদের প্রতি তার চেয়েও অধিক। ঐ সময় আরশ এবং ওর চারপাশের পর্দাসমূহ এবং আকাশ ও র মধ্যস্থিত সবকিছুই কেঁপে ওঠে বলেঃ “করুণাময় আল্লাহর জন্যেই সমস্ত প্রশংসা”। হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ যে ব্যক্তি রমযানের রোযা পূর্ণ করে রমযানের পরেও পাপমুক্ত জীবন যাপনের মনোভাব পোষণ করে সে বিনা প্রশ্নে ও বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
মুসনাদে আহমাদে হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু হতে বর্ণিত আছে যে,
রমযান মাস এসে গেলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন; “(হে জনমণ্ডলী) তোমাদের উপর রমযান মাস এসে পড়েছে। এ মাস খুবই বরকতপূর্ণ বা কল্যাণময়। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর এ মাসের রোযা ফরয করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানদেরকে বন্দী করে রাখা হয়। এ মাসে এমন একটি রাত্রি রয়েছে যে রাত্রি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ মাসে কল্যাণ হতে যে ব্যক্তি বঞ্চিত হয় সে প্রকৃতই হতভাগ্য।” (আহমাদ, নাসায়ী)
আবূ দাউদ তায়ালাসী (র) বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন;
“লায়লাতুল কাদর পরিষ্কার, স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ এবং শীত গরম হতে মুক্ত রাত্রি। এ রাত্রি শেষে সূর্য স্নিগ্ধ আলোকআভায় রক্তিম বর্ণে উদিত হয়।”
হযরত আবূ আসিম নুবায়েল (র) স্বীয় সনদে হযরত জাবির (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন যে,
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার বলেছিলেন; “আমাকে লায়লাতুল কাদর দেখানো হয়েছে। তারপর ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। রমযান মাসের শেষ দশ রাত্রির মধ্যে এটা রয়েছে। এ রাত্রি খুবই শান্তিপূর্ণ, মর্যাদাপূর্ণ, স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। এ রাত্রে শীতও বেশি থাকে না এবং গরমও বেশি থাকে না। এ রাত্রি এতো বেশি রওশন ও উজ্জ্বল থাকে যে, মনে হয় যেন চাঁদ হাসছে। রৌদ্রের তাপ ছড়িয়ে পড়ার আগে সূর্যের সাথে শয়তান আত্মপ্রকাশ করে না।”
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু হতে আরো বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন;
“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের নিয়তে কদরের রাত্রিতে ইবাদত করে, তার পূর্বাপর সমস্ত গুনাহ মার্জনা করে দেয়া হয়।” (বুখারী, মুসলিম)
প্রথমতঃ আল্লাহ তাআ’লা আমাদের বলে দিয়েছেন যে, এই রাত এক হাজার মাসের থেকেও উত্তম। অর্থাৎ এই এক রাতের ইবাদত এক হাজার মাসের থেকেও উত্তম। [আল্ মিসবাহ আল্ মুনীর/১৫২১]
তাই এই রাতটি ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করাই হবে আমাদের মূল উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয়তঃ জানা দরকার যে ইবাদত কাকে বলে? ইবাদত হচ্ছে, প্রত্যেক এমন আন্তরিক ও বাহ্যিক কথা ও কাজ যা, আল্লাহ পছন্দ করেন এবং তাতে সন্তুষ্ট থাকেন। [মাজমুউ ফাতাওয়া,১০/১৪৯]
উক্ত সংজ্ঞার আলোকে বলা যেতে পারে যে ইবাদত বিশেষ এক-দুটি কাজে সীমাবদ্ধ নয়। তাই আমরা একাধিক ইবাদতের মাধ্যমে এই রাতটি অতিবাহিত করতে পারি।
নিম্নে কিছু উৎকৃষ্ট ইবাদত উল্লেখ করা হলঃ
১- ফরয নামায সমূহ ঠিক সময়ে জামাআ’তের সাথে আদায় করা।
যেমন মাগরিব, ইশা এবং ফজরের নামায। তার সাথে সাথে সুন্নতে মুআক্কাদা, তাহিয়্যাতুল মসজিদ সহ অন্যান্য মাসনূন নামায আদায় করা।
২- কিয়ামে লাইলাতুল্ কদর করা।
অর্থাৎ রাতে তারবীহর নামায আদায় করা। নবী (সাঃ) বলেনঃ
“যে ব্যক্তি ঈমান ও নেকীর আশায় লাইলাতুল কদরে কিয়াম করবে (নামায পড়বে) তার বিগত গুনাহ ক্ষমা করা হবে”। [ফাতহুল বারী,৪/২৯৪]
এই নামায জামাআতের সাথে আদায় করা উত্তম। অন্যান্য রাতের তুলনায় এই রাতে ইমাম দীর্ঘ কিরাআতের মাধ্যমে নামায সম্পাদন করতে পারেন। ইশার পর প্রথম রাতে কিছু নামায পড়ে বাকী নামায শেষ রাতে পড়াতে পারেন। একা একা নামায আদায়কারী হলে সে তার ইচ্ছানুযায়ী দীর্ঘক্ষণ ধরে নামায পড়তে পারে।
৩- বেশী বেশী দুআ করা।
তন্মধ্যে সেই দুআটি বেশী বেশী পাঠ করা যা নবী (সাঃ) মা আয়েশা (রাযিঃ) কে শিখিয়েছিলেন।
মা আয়েশা নবী (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি লাইলাতুল কদর লাভ করি, তাহলে কি দুআ করবো? তিনি (সাঃ) বলেনঃ বলবে, (আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল্ আফওয়া ফা’ফু আন্নী”। [আহমদ,৬/১৮২] অর্থ, হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল। ক্ষমা পছন্দ কর, তাই আমাকে ক্ষমা কর”।
এছাড়া বান্দা পছন্দ মত দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকর যাবতীয় দুআ করবে। সে গুলো প্রমাণিত আরবী ভাষায় দুআ হোক কিংবা নিজ ভাষায় হোক। এ ক্ষেত্রে ইবাদতকারী একটি সুন্দর সহীহ দুআ সংকলিত দুআর বইয়ের সাহায্য নিতে পারে। সালাফে সালেহীনদের অনেকে এই রাতে অন্যান্য ইবাদতের চেয়ে দুআ করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কারণ এতে বান্দার মুক্ষাপেক্ষীতা, প্রয়োজনীয়তা ও বিনম্রতা প্রকাশ পায়, যা আল্লাহ পছন্দ করেন।
৪- যিকর আযকার ও তাসবীহ তাহলীল করা।
অবশ্য এগুলো দুআরই অংশ বিশেষ। কিন্তু বিশেষ করে সেই শব্দ ও বাক্য সমূহকে যিকর বলে, যার মাধ্যমে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করা হয়। যেমন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”, “আল্ হামদু ল্লিল্লাহ” “সুবহানাল্লাহ”, “আল্লাহুআকবার” “আস্তাগফিরুল্লাহ”, “লা হাওলা ওয়ালা কুউআতা ইল্লা বিল্লাহ”। ইত্যাদি।
৫- কুরআন তিলাওয়াত।
কুরআন পাঠ একটি বাচনিক ইবাদত, যা দীর্ঘ সময় ধরে করা যেতে পারে। যার এক একটি অক্ষর পাঠে রয়েছে এক একটি নেকী। নবী (সাঃ) বলেনঃ
“যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের একটি অক্ষর পড়বে, সে তার বিনিময়ে একটি নেকী পাবে… আমি একথা বলছি না যে, আলিফ,লাম ও মীম একটি অক্ষর; বরং আলিফ একটি অক্ষর লাম একটি অক্ষর এবং মীম একটি অক্ষর”। [তিরমিযী, তিনি বর্ণনাটিকে হাসান সহীহ বলেন]
এছাড়া কুরআন যদি কিয়ামত দিবসে আপনার সুপারিশকারী হয়, তাহলে কতই না সৌভাগ্যের বিষয়! নবী (সাঃ) বলেনঃ
“তোমরা কুরআন পড়; কারণ সে কিয়ামত দিবসে পাঠকারীর জন্য সুপারিশকারী হিসাবে আগমন করবে”। [মুসলিম]
৬- সাধ্যমত আল্লাহর রাস্তায় কিছু দান-সাদকা করা।
নবী (সাঃ) বলেনঃ
“সাদাকা পাপকে মুছে দেয়, যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়”। [সহীহুত তারগবি]
শবে কদরের একটি রাতে এই রকম ইবাদতের মাধ্যমে আপনি ৮৩ বছর ৪ মাসের সমান সওয়াব অর্জন করতে পারেন। ইবাদতের এই সুবর্ণ সুযোগ যেন হাত ছাড়া না হয়। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। আমীন!
উল্লেখ থাকে যে, ইবাদতের উদ্দেশ্যে বৈষয়িক কাজ-কর্মও ইবাদতে পরিণত হয়। যেমন রোযার উদ্দেশ্যে সাহরী খাওয়া, রাত জাগার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ-কর্ম সেরে নেওয়া। তাই লাইলাতুল কদরে ইবাদতের উদ্দেশ্যে বান্দা যেসব দুনিয়াবী কাজ করে সেগুলোও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।
আশা করি আপনাদের বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত কিছু আইডিয়া দিতে পেরেছি। ওয়ামা তাওফীক ইল্লা বিল্লাহ্