সিয়াম বা সওমের (রোযার) শাব্দিক অর্থ হলো- বিরত হওয়া বা রাখা।
শরীয়তের দৃষ্টিতে সিয়াম বলা হয় বিশেষ ধরণের বিরত থাকাকে।
অর্থাৎ সোয়াব অর্জনের ইচ্ছায় (নিয়তে) ফজর উদিত হওয়ার একটু পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত থাকাকে সিয়াম বলা হয়।
অনেকে বর্জনীয় বিষয় সমূহের মধ্যে অশ্লীল যে কোন কথা ও কাজকেও উল্লেখ করেছেন।
সিয়াম আদায় করা ফরয। এ কথার প্রমাণ হল- কুরআন, হাদীস এবং ইজমা। সূরা বাক্বারার ১৮৩নং আয়াত নাযিলের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা সিয়াম ফরয করেন।
আল্লাহ বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (সূরা বাক্বারা- ১৮৩)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
عَنِ ابْنِ عُمَرَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ بُنِيَ الْإِسْلَامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَصَوْمِ رَمَضَانَ وَحَجِّ الْبَيْتِ
অর্থঃ ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বিষয়ের উপর। আর তা হল: (১) একথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত ইবাদতের যোগ্য কোন মাবূদ নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল, (২) সালাত প্রতিষ্ঠা করা, (৩) যাকাত প্রদান করা, (৪) রামাযানের সিয়াম পালন করা এবং (৫) কাবা ঘরের হজ্জ পালন করা। (বুখারী ও মুসলিম)
অন্য এক হাদীসে এসেছে: জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে জিজ্ঞেস করল: হে আল্লাহর রাসূল! সিয়ামের মধ্যে থেকে আল্লাহ আমার উপর কি ফরয করেছেন? তিনি জবাবে বললেন: রামাযান মাসের সিয়াম। সে বলল: এছাড়া কি আমার উপর আবশ্যক কিছু আছে? তিনি বললেন: না, তবে তুমি যদি নফল কিছু আদায় কর। (বুখারী ও মুসলিম)
উম্মতে মুহাম্মাদীর সকল মানুষের ইজমা হয়েছে যে, রামাযান মাসের সিয়াম আদায় করা ফরয। এটা অস্বীকারকারী কাফের ও মুরতাদ।
শুধু সিয়াম নয়, যদি কোন মানুষ ইসলামের নির্ধারিত কোন একটি সুস্পষ্ট বিষয় যা পালন করা ইসলাম আবশ্যক করেছে, যার উপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত (যেমন সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ্জ.. প্রভৃতি) অস্বীকার করে, অথবা যা ইসলাম সুস্পষ্টভাবে যা করতে নিষেধ করেছে (যেমন মদ্যপান, মৃত প্রাণী ভক্ষণ, শুকর ভক্ষণ, ব্যভিচার, সুদ.... ইত্যাদি নিষিদ্ধ বিষয়কে) অস্বীকার করে, তাহলে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। কাফের বা মুরতাদ হয়ে যাবে।
কোন মানুষ রোজা আদায় করা ফরয একথা আন্তরিকভাবে স্বীকার করার পরেও যদি অলসতা বশত: তা বর্জন করে আদায় না করে তাহলে সে বিশুদ্ধ মতে কাবীরা গুনাহে লিপ্ত হবে। অতএব তার উপর আবশ্যক হল, আল্লাহর কাছে তাওবা করতে হবে এবং ছেড়ে দেয়া ঐ সিয়ামগুলো কাযা আদায় করতে হবে।
এসম্পর্কে ওলামাদের দুটি মত রয়েছে তার মধ্যে এটাই অধিক বিশুদ্ধ।
কেননা কোন কোন বিদ্বান ইচ্ছাকৃত সিয়াম পরিত্যাগকারীকে কাফের বলেছেন।
عَنْ أَبِيْ أُماَمَةَ الباهلي رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قاَلَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يقول بَيْنَا أَنَا نَائِمٌ أَتَانِي رَجُلاَنِ ، فَأَخَذَا بِضَبْعَيَّ ، فَأَتَيَا بِي جَبَلاً وَعْرًا ، فَقَالاَ: اصْعَدْ ، فَقُلْتُ : إِنِّي لاَ أُطِيقُهُ ، فَقَالاَ : إِنَّا سَنُسَهِّلُهُ لَكَ، فَصَعِدْتُ حَتَّى إِذَا كُنْتُ فِي سَوَاءِ الْجَبَلِ إِذَا بِأَصْوَاتٍ شَدِيدَةٍ ، قُلْتُ: مَا هَذِهِ الأَصْوَاتُ ؟ قَالُوا: هَذَا عُوَاءُ أَهْلِ النَّارِ ، ثُمَّ انْطُلِقَ بِي ، فَإِذَا أَنَا بِقَوْمٍ مُعَلَّقِينَ بِعَرَاقِيبِهِمْ ، مُشَقَّقَةٍ أَشْدَاقُهُمْ ، تَسِيلُ أَشْدَاقُهُمْ دَمًا ، قَالَ : قُلْتُ : مَنْ هَؤُلاَءِ ؟ قَالَ : الَّذِينَ يُفْطِرُونَ قَبْلَ تَحِلَّةِ صَوْمِهِمْ . رواه ابن خزيمة وابن حبان
আবু উমামা আল বাহেলী (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)কে বলতে শুনেছি:
“একদা আমি ঘুমন্ত ছিলাম এমন সময় (স্বপ্নে) আমার নিকট দু’জন লোক এল। তারা আমার বাহু ধরে আমাকে নিয়ে একটি কঠিন ভয়ানক পাহাড়ের কাছে নিয়ে গেল। তারা বলল: পাহাড়ে উঠুন। বললাম, আমি পারব না। তারা বলল, আমরা আপনাকে সহযোগিতা করব। তারপর আমি পাহাড়ে উঠলাম। যখন আমি পাহাড়ের চুঁড়ায় পৌঁছলাম এমন সময় বিকট কিছু আওয়াজ শুনতে পেলাম। প্রশ্ন করলাম, কিসের আওয়াজ? তারা বলল, জাহান্নামবাসীদের চিৎকার।
তারপর তারা আমাকে নিয়ে সামনে চলল। এমন সময় আমি একদল লোক দেখলাম, যাদেরকে বুকের সামনের হাড়ের সাথে (আংটা দিয়ে) লটকিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের (উভয় ঠোঁটের মধ্যে দিয়ে) গাল ফেড়ে ফেলা হয়েছে। সেখান থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। আমি বললাম, এরা কারা? তারা বলল, যারা ইফতারের সময় হওয়ার আগেই (ইচ্ছাকৃতভাবে) রোযা ভঙ্গ করে ফেলত।”
(সহীহ ইবেন খুযায়মা ও সহীহ ইবনে হিব্বান ও নাসাঈ ফি সুনানিল কুবরা, আলবানী হাদীছটি সহীহ বলেছেন, দ্র: সহীহ তারগীব ও তারহীব হা/১০০৫)
কেউ যদি পরস্পর কয়েক বছর সিয়াম বর্জন করে থাকে, অত:পর সে তাওবা করে ইসলামে ফিরে আসে, তবে তার উপর আবশ্যক হচ্ছে খাঁটিভাবে তাওবা করা।
কাযা আদায় করতে হবে কিনা এ নিয়ে উলামাদের মধ্যে এখতেলাফ আছে।
জমহূর উলামাদের মতে ছুটে যাওয়া সবগুলো রমজানের সিয়াম তাকে অবশ্যই আদা আদায় করতে হবে। বরং শায়খ বিন বায বলেছেন ছুটে যাওয়া প্রতিটি সিয়ামের বিনিময় একজন করে মিসকীনকে অর্ধ সা’ পরিমাণ খাদ্য প্রদান করবে।
কিন্তু ইমাম ইবনে তায়মিয়া, শায়খ ইবনে উসাইমীনসহ অন্য আলেমগণ বলেছেন, কাযা আদায় করার দারকার নেই। শুধু খাঁটিভাবে তাওবা করলেই হবে।
কখন সিয়াম ফরয হয়: সিয়াম ফরয হয় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর হিজরতের ২য় বর্ষে, শাবান মাসের ২৮ তারিখে, সোমবার দিন। (ফিকহুস সুন্নাহ: ২/৫০১)
রোযা ফরয হওয়ার প্রথম অবস্থা: প্রথম যখন রোযা ফরয হয়, তখন তা মানুষের ইচ্ছাধীন করা হয়েছিল। যার মনে চায় সে রোযা পালন করবে, যার মনে চায় রোযা রাখবে না, কিন্তু বিনিময়ে সে তার ফিদিয়া আদায় করে দিবে। আল্লাহ বলেন,
أَيَّامًا مَّعْدُودَٰتٍۚ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَۚ وَعَلَى ٱلَّذِينَ يُطِيقُونَهُۥ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍۖ فَمَن تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُۥۚ وَأَن تَصُومُوا۟ خَيْرٌ لَّكُمْۖ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ
হাতে গোনা কয়েক দিন মাত্র রোযা রাখতে হবে। অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে। আর যাদের জন্য সিয়াম কষ্টসাধ্য তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদ্ইয়া- একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে তবে তা তার জন্য কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণের যদি তোমরা জানতে। (বাকারা: ১৮৪)
এই আয়াতের স্বাভাবিক অর্থ দাঁড়ায়, যেসব লোক রোগজনিত কারণে কিংবা সফরের দরুন নয়; বরং সাওম রাখার পূর্ণ সামর্থ থাকা সত্বেও সাওম রাখতে চায় না, তাদের জন্যও সাওম না রেখে সাওমের বদলায় ‘ফিদইয়া দেয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সাথে সাথেই এতটুকু বলে দেয়া হয়েছে যে, ‘সাওম রাখাই হবে তোমাদের জন্য কল্যাণকর। উপরোক্ত নির্দেশটি ছিল ইসলামের প্রাথমিক যুগের, যখন লক্ষ্য ছিল ধীরে ধীরে লোকজনকে সাওমে অভ্যস্ত করে তোলা। এরপর নাযিলকৃত আয়াত:
(فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ) “কাজেই তোমাদের মধ্যে যে এ মাস (রামাযান) পাবে সে যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে” (বাকারা: ১৮৫)
এই আয়াত দ্বারা প্রাথমিক এ নির্দেশ সুস্থ-সবল লোকদের ক্ষেত্রে রহিত করা হয়েছে। তবে যেসব লোক অতিরিক্ত বার্ধক্য জনিত কারণে সাওম রাখতে অপরাগ কিংবা দীর্ঘকাল রোগ ভোগের দরুন দূর্বল হয়ে পড়েছে, অথবা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে একেবারেই নিরাশ হয়ে পড়েছে, সেসব লোকের বেলায় উপরোক্ত নির্দেশটি এখনো প্রযোজ্য রয়েছে। সাহাবী ও তাবেয়ীগণের সর্বসম্মত অভিমত তাই ৷
সাহাবী সালামাহ ইবনুল আকওয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, যখন (وَعَلَي الَّذِيْنَ يُطِيْقُوْنَهٗ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِيْنٍ) “আর যাদের জন্য সিয়াম কষ্টসাধ্য তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদ্ইয়া- একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করা”। শীর্ষক আয়াতটি নাযিল হয়, তখন আমাদেরকে এ মর্মে ইখতিয়ার দেয়া হয়েছিল যে, যার ইচ্ছা হয় সে সাওম রাখতে পারে এবং যে সাওম রাখতে চায় না, সে ‘ফিদইয়া’ দিয়ে দেবে। এরপর যখন পরবর্তী আয়াত (فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ) “কাজেই তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে”। (বাকারা: ১৮৫) নাযিল হল, তখন ফিদইয়া দেয়ার ইখতিয়ার মানসূখ বা রহিত হয়ে সুস্থ-সমর্থ লোকদের উপর শুধুমাত্র সাওম রাখাই ফরয সাব্যস্ত হয়ে গেল। [বুখারী ৪৫০৭, মুসলিম: ১১৪৫, আবু দাউদ:২৩১৫, ২৩১৬ ও তিরমিযী: ৭৯৮] (দেখুন তাফসীর আবু বকর যাকারিয়া ১৮৪ নং আয়াতের তাফসীর)
আরেকটি অবস্থা: এশার সময় পর্যন্ত পানাহারের অনুমতি ছিল।
সিয়াম ফরয হওয়ার পর আরেকটি নিয়ম এরকম ছিল যে, ইফতার করার পর এশা নামাযের পূর্ব পর্যন্ত পানাহারের অনুমতি ছিল। এই সময়ের মধ্যে কোন কিছু খেতে না পরে, তাহলে সে আর খেতে পাবে না। এভাবেই না খেয়ে রোযা রাখতে হবে। কিন্তু পরে এই বিধানটিও রহিত করা হয়।
বারা বিন আযেব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীগণের অবস্থা এই ছিল যে, যদি তাঁদের কেউ সওম পালন করতেন তাহলে ইফ্তারের সময় হলে ইফ্তার না করে নিদ্রা গেলে সে রাত্রে এবং পরের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছুই খাওয়ার অনুমতি ছিল না।
কায়স ইব্নু সিরমা আনসারী (রাঃ) সওম করেছিলেন। ইফ্তারের সময় তিনি তাঁর স্ত্রীর নিকট এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে কিছু খাবার আছে কি? তিনি বলেলন, না, তবে আমি যাচ্ছি, দেখি আপনার জন্য কিছু খোঁজ করে আনি। তিনি দিনে কাজে নিয়োজিত থাকতেন। তাই ঘুমে তাঁর দু’চোখ বুজে গেল। ওদিকে এশারের সময় হয়ে গেল। এরপর তাঁর স্ত্রী এসে যখন তাঁকে দেখলেন, তখন তাঁকে বললেন, হায়, তুমি বঞ্চিত হয়ে গেলে! পরদিন দুপুর হলে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। এ ঘটনাটি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট উল্লেখ করা হলে কুরআনের এ আয়াত অবতীর্ণ হয়- {أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَائِكُمْ} “সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী সহবাস হালাল করা হয়েছে”। (আল-বাকারাহ্: ১৮৭)। এর হুকুম সম্বন্ধে অবহিত হয়ে সাহাবীগণ খুবই খুশি হলেন। এরপর নাযিল হলঃ {وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمْ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنْ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ “আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের সাদা রেখা পরিষ্কার দেখা যায় বা ফজরের শুভ্রতা প্রকাশ পায়” (আল-বাকারাহ্: ১৮৭)। [হাদীছটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী হা/১৯১৫]
সিয়াম ২ প্রকার: (১) ফরয সিয়াম ও (২) নফল সিয়াম
(১) ফরয সিয়াম আবার ৩ প্রকার:
(ক) রামাযানের সিয়াম
(খ) কাফফারার সিয়াম
(গ) মানতের সিয়াম
(২) নফল সিয়াম অনেক প্রকারের আছে। সেগুলোর বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসবে। ইন শা আল্লাহ
নিম্ন লিখিত শর্তযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির উপর সিয়াম ফরযঃ
(ক) মুসলিম, কাফেরের উপর সিয়াম ফরয নয়।
(খ) বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক, নাবালেগের উপর সিয়াম ফরয নয়।
(গ) সুস্থ মস্তিস্ক বা আকেল সম্পন্ন ব্যক্তির উপর, বেহুঁশ বা পাগলের উপর সিয়াম ফরয নয়।
(ঘ) গৃহে অবস্থানকারী, মুসাফিরের উপর সিয়াম ফরয নয়। (তবে তারা রোযা ভঙ্গ করলে পরবর্তীতে কাযা আদায় করবে)
(ঙ) দৈহিক ভাবে সক্ষম, অক্ষম বা অসুস্থ ব্যক্তির উপর সিয়াম ফরয নয়।
(চ) শরঈ বাধা মুক্ত হওয়া, যেমন নারীর ক্ষেত্রে সে যদি হায়েয বা নেফাস যুক্ত হয় তবে তার উপর সিয়াম ফরয নয়। (তারা পরবর্তীতে ঐ রোযাগুলোর কাযা আদায় করবে)
* দিনের বেলায় যদি কোন কাফের ইসলাম গ্রহণ করে বা কোন বালক-বালিকা বালেগ হয় বা কোন পাগল যদি ভাল হয়ে যায়, তবে তারা রোযার হুকুমের আওতায় এসে যাবে এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত পনাহার থেকে বিরত থাকবে, রোযার সম্মান রক্ষার্থেই শুধু এই বিরত থাকা, যদিও এটা তার সিয়াম হিসেবে গণ্য হবে না। তবে তার পরদিন থেকে নিয়মিত রোযা পালন করবে। এর পূর্বের রোযাগুলোর ক্বাযা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। যেহেতু আগের দিনগুলোতে তাদের উপর রোযা ফরয ছিল না।
* সাত বছরের বালক-বালিকাদেরকে রোযা পালনে উৎসাহ দেয়া উচিত, যদি তারা সক্ষম হয় তবে তারা রোযার সোওয়াব পাবে এবং পিতা-মাতা ভাল কাজের প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ দেয়ার সওয়াব পাবেন। রুবাঈ বিনতে মুআওয়ায (রা:)বলেনঃ
كُنَّا نَصُومُهُ بَعْدُ وَنُصَوِّمُ صِبْيَانَنَا وَنَجْعَلُ لَهُمُ اللُّعْبَةَ مِنَ الْعِهْنِ فَإِذَا بَكَى أَحَدُهُمْ عَلَى الطَّعَامِ أَعْطَيْنَاهُ ذَاكَ حَتَّى يَكُونَ عِنْدَ الْإِفْطَارِ
যখন আশুরার রোযা ফরয ছিল, তখন আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদেরকে রোযা রাখাতাম, আর খাবার জন্য কান্না শুরু করলে তাদেরকে তুলা দিয়ে তৈরী এক প্রকার আকর্ষনীয় খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম, আমরা এটা করতাম ইফতারের সময় পর্যন্ত। (বুখারী হা/১৯৬০ মুসলিম হা/২৭২৫)
(১) সিয়াম বান্দা ও মাবুদের মাঝে গোপন ইবাদত। এ ইবাদতের মাধ্যমে বান্দার ঈমান অভূতপূর্ব শক্তি সঞ্চিত হয়। বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় ও আকর্ষনীয় বস্তু ও বিষয়াদীকে ফজরের পূর্বে থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত বর্জন করে থাকা এবং গোপন ও প্রকাশ্য কোন অবস্থাতে উহার ধারে কাছে না যাওয়া প্রমাণ করে যে, সে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণকে ইয়াক্বীন করে।
(২) নিজের আত্মাকে পবিত্র করা। একজন মুসলিম সিয়ামের মাধ্যমে নিজের চরিত্রকে সুন্দর করতে পারে, নিকৃষ্ট স্বভাব ও আচরণ থেকে পবিত্র করতে পারে। কেননা সিয়াম মানুষের শরীরে শয়তানের চলাচলকে সংকীর্ণ ও সীমিত করে দেয়া।
(৩) সিয়াম বান্দাকে আখিরাতমুখী করে। দুনিয়ার ভোগ বিলাস থেকে মুক্ত হয়ে আখেরাতের পুরস্কারের আশাবাদী হয়।
(৪) সিয়াম বান্দার জন্য মাবুদের আনুগত্য ও তাঁর বিধানের নিকট আত্মসমপর্ণ করার সাফল্যজনক ট্রেনিং। আল্লাহ রাতে খেতে, পান করতে ও স্ত্রী সহবাস করতে বলেছেন তাই তা করে। আর ফজর উদিত হওয়ার সাথে সাথে ওসব থেকে ক্ষান্ত হয়ে সূর্য ডুবা পর্যন্ত বিরত থাকতে বলেছেন তাই তা থেকে বিরত থাকে।
(৫) সিয়াম সামাজিকতার প্রশিক্ষণ দেয়। সিয়াম পালনকারী যখন দেখে যে, তার আশে পাশের সকলেই সিয়াম সাধনায় রত, তখন তার জন্য সিয়াম হালকা মনে হবে এবং সমাজে ঐক্যের এক মনোরম পরিবেশ অনুভব করবে।
(৬) ধনী শ্রেণীর লোকেরা এ মাসে রোযার মাধ্যমে ক্ষুৎপিপাসার যন্ত্রণা অনুভব করলে, ফকীর মিসকিনদের অবস্থা বুঝবে ও তাদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়াবে।
(ক) আল্লাহ এ মাসের সম্মানে জান্নাতের দরজাগুলেঅ খুলে দেন, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেন এবং শয়তানকে শৃংখলাবদ্ধা করেন:
إِذَا دَخَلَ رَمَضَانُ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ جَهَنَّمَ وَسُلْسِلَتِ الشَّيَاطِينُ
যখন রামাদ্বান মাস শুরু হয়, জান্নাতের দরজাগুলো খোলা হয়। জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করা হয়। শয়তানদেরকে শিকল পরান হয়। (বুখারী) অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে,
إِذَا دَخَلَ شَهْرُ رَمَضَانَ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ
রামাদ্বান মাসে আসমানের দরজা সমূহ খোলা হয়। কোন কোন বর্ননায় এসেছে,
وَتُغَلُّ فِيهِ مَرَدَةُ الشَّيَاطِينِ
বেশী উশৃংখল শয়তানগুলোকে বন্ধ করা হয়। (নাসাঈ)
(খ) রামাদ্বান কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার মাস। আল্লাহ বলেন,
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ
"রামাদ্বান এমন মাস যার ভিতর কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে"। (সূরা বাকারাহ - ১৮৫)
(গ) এই মাসে লায়তুল ক্বাদর রয়েছে যা হলো এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ "ক্বদরের রাত্রির ইবাদত এক হাজার মাস ইবাদতের চাইতে উত্তম"। (সূরা ক্বাদর-৩)
রামাদ্বান মাস উপস্থিত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন,
دَخَلَ رَمَضَانُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ هَذَا الشَّهْرَ قَدْ حَضَرَكُمْ وَفِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ مَنْ حُرِمَهَا فَقَدْ حُرِمَ الْخَيْرَ كُلَّهُ وَلَا يُحْرَمُ خَيْرَهَا إِلَّا مَحْرُومٌ
তোমাদের নিকট এমন একটি মাস উপস্থিত হয়েছে, যার ভিতর এমন একটি রজনী রয়েছে যা এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতটির কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়, সে যেন সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত। আর তার কল্যাণ থেকে ঐ সকল লোকই বঞ্চিত হয় যারা চিরবঞ্চিত। (হাদীছটি ইবনু মাজাহ হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন। হাদীছ নং ১৬৪৪)
(ঘ) গুনাহ মোচনের মাস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
]مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ [
যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছাওয়াবের আশায় রমযানের সিয়াম পালন করে তার পূর্বকৃত সমস্ত পাপ মোচন করা হয়। এমনিভাবে যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছাওয়াবের আশায় লায়লাতুল ক্বাদরের রাতে কিয়াম করে তারও পূর্বকৃত সকল গুনাহ মোচন করা হয়। (বুখারী ও মুসলিম)
অন্য বর্ণনায় আছে,
مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছাওয়াবের আশায় রামাদ্বানের রাত্রি বেলা কিয়াম (নফল সুন্নত সালাত আদায়) করে তার পূর্বকৃত সকল পাপ মোচন করা হয়। (বুখারী, মুসলিম)
(ঙ) রামাদ্বানের প্রতি দিন ও রাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি:
“রামাদ্বান মাসের প্রথম দিন যখন আগমন তখন ... একজন আহবানকারী আহবান করতে থাকেনঃ হে কল্যাণের অনুসন্ধানকারী অগ্রসর হও। হে অকল্যাণের অনুসন্ধানকারী থেমে যাও। আল্লাহর পক্ষ থেকে অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত ঘোষণা করা হয় এবং তা প্রত্যেক রাতেই হতে থাকে। (তিরমিযী হা/৬৮২)
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
“নিশ্চয় আল্লাহ্ তাবারাক ওয়া তা’আলার পক্ষ থেকে প্রত্যেক দিন ও রাতে অনেক লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করা হয় অর্থাৎ রামাদ্বান মাসে। আর নি:সন্দেহে (রামাদ্বানের) প্রত্যেক দিন ও রাতে প্রত্যেক মুসলমানের দু’আ কবূল করা হয়।”( আহমাদ হা/৭৪৪৩, , দ্র: সহীহ তারগীব ও তারহীব হা/১০০২)
আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যেক দিন ইফতারের সময় অনেক লোককে (জাহান্নাম থেকে) মুক্ত করা হয়।”
(আহমাদ হা/২২২৫৬, ত্বাবরানী ও বায়হাক্বী, , দ্র: সহীহ তারগীব ও তারহীব হা/১০০১)
(চ) রামাদ্বান দুয়া কবূল হওয়ার মাস।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ لِلصَّائِمِ عِنْدَ فِطْرِهِ لَدَعْوَةً مَا تُرَدُّ
সিয়াম পালনকারীর ইফত্বারের সময়কার দুয়া প্রত্যাখ্যান করা হয় না। (হাদীছটি ইব্নু মাজাহ বর্ণনা করেছেন। উহার সনদ সহীহ, হাদীছ নং ১৭৫৩)
(ছ) দুর্ভাগা মানুষ ছাড়া কেউ এ মাসে বঞ্ছিত হয় না: কা’ব বিন ঊজরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
“মিম্বার উপস্থিত কর। আমরা মিম্বার হাযির করলাম। তিনি একটি সিঁড়িতে উঠে বললেনঃ “আমীন” দ্বিতীয় সিঁড়িতে উঠে বললেনঃ “আমীন” তৃতীয় সিঁড়িতে উঠে বললেনঃ “আমীন”
তিনি মিম্বর থেকে অবতরন করলে আমরা প্রশ্ন করলাম: হে আল্লাহর রাসূল! আজ আমরা আপনার নিকট থেকে এমন কিছু শুনলাম যা কখনো শুনিনি। তিনি বললেনঃ
“জিবরীল (আঃ) আমার কাছে এসেছিলেন তিনি বললেনঃ যে ব্যক্তি রামাদ্বান পেল অথচ তাকে ক্ষমা করা হল না, সে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হোক। আমি বললাম: ‘আমীন’। দ্বিতীয় সিঁড়িতে উঠার সময় তিনি বললেনঃ যার সামনে আপনার নাম উল্লেখ করা হল অথচ আপনার উপর দরূদ পাঠ করল না সে (আল্লাহর রহমত থেকে) বঞ্চিত হোক। আমি বললাম: ‘আমীন’। তৃতীয় ধাপে উঠলে তিনি বললেনঃ যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতা দু’জনকে অথবা একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল অথচ তাদের খেদমত করে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না সে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হোক। আমি বললাম: ‘আমীন’। (হাকেম হা/৭২৫৭, হাদীছটি সহীহ দ্র: সহীহ তারগীব ও তারহীব হা/৯৯৫)
(ক) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, الصِّيَامُ جُنَّةٌ ، يَسْتَجِنُّ بِهَا الْعَبْدُ مِنَ النَّارِ সিয়াম হচ্ছে ঢাল স্বরূপ, এর দ্বারা মুমিন ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে। (ছহীহুল-জামে আস সগীর ৩৮৬৭নং হাদীছ)
(খ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ঘোষণা মতে সিয়াম যৌন স্প্রিহার ক্ষতিকর উত্তেজনা থেকে রক্ষা করার ব্যাপারে ঢাল স্বরূপ। (বুখারী-হাদীস নং ১৯০৫, মুসলিম-হাদীস নং ৩৮৬৭ ১৪০০)
সওমকে এজন্যে ঢাল বলা হয়েছে যে, সওম কুপ্রবৃত্তি থেকে মানুষকে বিরত রাখে। আর জাহান্নামকে খাহেশাতের বিষয় দ্বারা ঘিরে রাখা হয়েছে। যেমনটি নবী (সাঃ) বলেনঃ জান্নাতকে অপসন্দনীয় বিষয় দ্বারা ঘিরে রাখা হয়েছে এবং জাহান্নামকে ঘিরে রাখা হয়েছে খাহেশাতপূর্ণ (প্রবৃত্তিতাড়িত) বিষয় দ্বারা। মোটকথা সওম মানুষকে আল্লাহ্ অপসন্দ করেন এমন সব বিষয় থেকে বাঁচিয়ে রাখে।
(গ) রোযাদ্বার রাইয়্যান নামক দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ فِي الْجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لَا يَدْخُلُ مَعَهُمْ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ يُقَالُ أَيْنَ الصَّائِمُونَ فَيَدْخُلُونَ مِنْهُ فَإِذَا دَخَلَ آخِرُهُمْ أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ
জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যার নাম বলা হয় 'রাইয়্যান', কিয়ামতের দিন ঐ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে কেবল সিয়াম পালনকারীগণ। উহার ভিতর দিয়ে তারা ব্যতীত আর কেউ-ই প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হবে সিয়াম পালনকারীগণ কোথায়? তখন তারা উঠে সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে, তারা ছাড়া ঐ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। যখন তারা প্রবেশ করবে তখন সেই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। ফলে আর কেউ সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী-হাদিস নং ১৮৯৬, মুসলিম-হাদীছ নং ১১৫২)
(ঘ) সিয়াম অবস্থায় মারা গেলে জান্নাত: হুযায়ফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একদা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে আমার বুকের উপর হেলান দিয়ে বসিয়ে রেখেছিলাম। তখন তিনি বললেনঃ
“যে ব্যক্তি বলবে (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্) যদি এ কথার উপরেই (তার জীবন) শেষ হয়, তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে ব্যক্তি একদিন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সিয়াম পালন করবে, যদি এ অবস্থাতেই (তার জীবন) শেষ হয়, তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করে একটি সাদকা করবে, যদি তার উপরেই (তার জীবন) শেষ হয়, তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (আহমাদ হা/২৩৩৭২, দ্র: সহীহ তারগীব ও তারহীব হা/৯৮৫)
(ঙ) সিয়াম সুপারিশকারী হবে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, সিয়াম মুমিন ব্যক্তির জন্য কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সুপারিশকারী হবে এবং আল্লাহ তার সুপারিশ কবুলও করবেন।
الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَقُولُ الصِّيَامُ أَيْ رَبِّ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ وَيَقُولُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ قَالَ فَيُشَفَّعَانِ
আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আ’স (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
“ক্বিয়ামত দিবসে সিয়াম ও কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সিয়াম বলবে: হে আমার পালনকর্তা! আমি তাকে দিবসে পানাহার ও যৌনকর্ম থেকে বিরত রেখেছিলাম। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবূল কর। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছিলাম। তাই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবূল কর। তিনি বলেনঃ তখন তাদের উভয়ের সুপারিশ কবূল করা হবে।”
(হাদীছটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমাদ ও ত্বাবরানী [কাবীর গ্রন্থে], ইবনে আবী দুনিয়া [আল জু’ও গ্রন্থে] উত্তম সনদে এবং হাকেম। হাকেম বলেনঃ মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদীছটি সহীহ্)
অর্থাৎ তাদের (সিয়াম ও কুরআনের) সুপারিশ কবুল করে আল্লাহ বান্দাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। মুনাভী বলেনঃ সম্ভাবনা আছে যে এই কথাটি প্রকৃত অর্থেই। অর্থাৎ এ দু’টি আমল স্বশরীরে উপস্থিত হবে এবং আল্লাহ্ তাদের মধ্যে কথা বলার শক্তি সৃষ্টি করে দিবেন। (আল্লাহ্ প্রত্যেক বস্তুর উপর ক্ষমতাবান)। অথবা এই কথাটি রূপক ও দৃষ্টান্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। শায়খ আলবানী বলেনঃ সঠিক কথা হচ্ছে প্রথমটিই। এর উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখা উচিত। আমল সমূহকে যে স্বশরীরে উপস্থিত করা হবে সে সম্পর্কে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যেমন গচ্ছিত সম্পদকে টাক মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপে পরিণত করা হবে। এ ধরণের উক্তি সমূহকে প্রকৃত অর্থে ব্যবহার না করে রূপক বা অন্য কোন অর্থে ব্যবহার করা সালাফে সালেহীনের নীতি নয়। বরং এটা বিভ্রান্ত ফেরকা মু’তাযেলা এবং তাদের অনুসারীদের নীতি। কেননা এরূপ ব্যাখ্যা করলে ঈমানের প্রথম শর্ত (যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে) তার বিপরীত করা হবে। অতএব তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা থেকে সাবধান।
(চ) সিয়াম গুনাহ মাফ করানোর জন্য বৃহৎ সাফল্যজনক উপায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছাওয়াবের আশায় রমযানের সিয়াম পালন করে, তার পূর্বকৃত সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (বুখারী হাদীস- নং ১৯০১)
(ছ) সিয়াম মুমিন ব্যক্তির জন্য ইহ ও পরকালের সুখ-শান্তি লাভের উৎকৃষ্টতম উপায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ يَفْرَحُهُمَا إِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ وَإِذَا لَقِيَ رَبَّهُ فَرِحَ بِصَوْمِهِ
সিয়াম পালনকারীর জন্য দুধরনের খুশী রযেছে - একটি খুশী - ইফত্বারের সময় ও অপরটি তার প্রতিপালকের সহিত সাক্ষাতের সময়। (বুখারী হাদীছ নং ১৯০৪, মুসলিম হাদীছ নং ১১৫১)
(জ) সিয়াম এমনই ইবাদত যার সোয়াব ও প্রতিদান আল্লাহ নিজে দান করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, (হাদীছে কুদসীতে) আল্লাহ বলেন,
كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلَّا الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ
আদম সন্তানের প্রতিটি আমল তার জন্য- অর্থাৎ প্রায় প্রতিটি আমলে তার নিজের কিছু না কিছু স্বার্থ ঢুকে, কিন্তু সিয়াম শুধুমাত্র আমার জন্যই করা হয়। অতএব আমি তার প্রতিদান দান করবো। (বুখারী হাদীছ নং ১৯০৪, মুসলিম মাদীছ নং ১১৫১)
(ঞ) সিয়ামের বদৌলতে সিয়াম পালনকারীর মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের সুগন্ধীর চেয়েও বেশী উত্তম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ
সেই যাতের কসম যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিসকের সুগন্ধীর চেয়েও বেশী উত্তম। (বুখারী হাদীছ নং ১৮৯৪ ও ১৯০৪, মুসলিম হাদীছ নং ১১৫১)
(ট) সিয়ামের মাধ্যমে নৈকিত চরিত্র ও ব্যবহার সুন্দর হয়। কারণ সিয়ামের অবস্থায় অশ্লীল কথা ও কাজ এবং লড়াই-ঝগড়া সবই নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلَا يَرْفُثْ وَلَا يَصْخَبْ فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ
যখন তোমাদের কারো সিয়ামের দিন উপস্থিত হয়, তখন সে যেন কোন অশ্লীল কথা ও কাজ না করে এবং অহেতুক উচু কন্ঠে কথা না বলে অর্থাৎ ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় বা তার সহিত লড়াই-ঝগড়া করতে আসে তবে সে যেন তাকে বলে দেয়, আমি সিয়াম ব্রতে রত আছি। (বুখারী হাদীছ নং ১৯০৪, মুসলিম নং ১১৫১)
অন্য একটি হাদীছে এসেছে
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ
যে ব্যক্তি সিয়াম রত অবস্থায় মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করে না, আল্লাহর কোনই দরকার নেই তার পানাহার ত্যাগ করাতে। (বুখারী হাদীছ নং ১৯০৩)