সালাম হলো একটি আরবি অভিবাদনবাচক শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে শান্তি, প্রশান্তি কল্যাণ, দোয়া, আরাম, আনন্দ, তৃপ্তি। সালাম একটি সম্মানজনক, অভ্যর্থনামূলক, অভিনন্দনজ্ঞাপক, শান্তিময় উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন পরিপূর্ণ ইসলামী অভিবাদন।
পূর্ণরূপ: আস-সালামু আলাইকুম ওয়া-রাহমাতুল্লাহি ওয়া-বারাকাতু;
আরবি: ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ ٱللَّٰهِ وَبَرَكَاتُهُ
অর্থ: আপনার/তোমার উপর শান্তি, আল্লাহর দয়া, আল্লাহর কৃপা
সামাজিক শিষ্টাচার ও চারিত্রিক উৎকর্ষ মুসলিমদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এ কারণেই ইসলামে সামাজিক শিষ্টাচারকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সামাজিক আচার-আচরণের ক্ষেত্রে ইসলামের সুনির্দিষ্ট নীতিমালাও রয়েছে। বস্তুত ইসলামের সামাজিক বিধান এতটাই পরিপূর্ণ ও সুবিন্যস্ত যে, এর নজির বিরল।
সালাম স্বতন্ত্র সামাজিক শিষ্টাচার। একজনের সঙ্গে অন্যজনের সাক্ষাৎ হলে একে অন্যের কল্যাণ কামনায় সালাম দিয়ে কথা শুরু করে মুসলিমরা। স্বয়ং আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে সালামের আদেশ দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত আদব ও নিয়মাবলী শিখিয়েছেন। আর রাসুল (সা.) বহু হাদিসে সালামের বিধি-বিধান বর্ণনা করেছেন। হাদিসগুলো সংকলন করলে স্বতন্ত্র একটি বইয়ে রূপ নেবে।
কারও ঘরে প্রবেশের সময় আল্লাহতায়ালা মুমিনদের সালামের নির্দেশ দিয়েছেন, ‘যখন তোমরা ঘরে ঢুকবে নিজেদের লোকদের সালাম করবে কারণ এটা সাক্ষাতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত বরকতপূর্ণ ও পবিত্র দোয়া। (সুরা নুর, আয়াত : ৬১)
আরেক আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! নিজ ঘর ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না অনুমতি গ্রহণ করো এবং তার বাসিন্দাদের সালাম দাও।’ (সুরা নুর, আয়াত : ২৭)
আর সালামের জবাব কীভাবে দিতে হবে তাও শেখানো হয়েছে পবিত্র কোরআনে। সালামের বাক্য থেকে উত্তম বাক্যে ও বাড়িয়ে উত্তর দেবে; না হলে অন্তত সালামদাতার সমান বাক্যে উত্তর দেবে। যে ব্যক্তি সালাম শুনেছে, সালামের জবাব দেওয়া তার উপর ওয়াজিব। জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা গ্রহণযোগ্য নয়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যখন তোমাদের কেউ সালাম দেয়, তখন তোমরা (তাকে) তদপেক্ষা উত্তমরূপে সালাম (জবাব) দাও, কিংবা (অন্ততপক্ষে) সে শব্দেই সালামের জবাব দাও।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৮৬)
সত্যিকারের মুসলিম কখনো সালাম দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে না। সালাম দেওয়ার জন্য শরিয়ত নির্ধারিত বাক্য হলো ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’। মহানবী (সা.) এ বাক্যে সালাম দিতেন এবং মুসলিমদের এভাবে সালাম দিতে শিখিয়েছেন। একবার এক ব্যক্তি এসে তাকে সালাম দিল ‘আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলুল্লাহ’ (এ বাক্যে)। তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘এটা তো মৃতদের অভিবাদন (একথা তিনি তিনবার বললেন)। এরপর বললেন, ‘যখন কেউ তার মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তখন যেন সে বলে, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৭২১)
সালামের বাক্য স্বয়ং আল্লাহতায়ালা নির্বাচন করেছেন। আদম সন্তানদের জন্য এই বাক্যকেই অভিবাদন স্বরূপ নির্ধারণ করেছেন। এ বাক্যের ভাব ও ভাষা, শব্দ ও সৌন্দর্য তুলনাহীন। হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা আদম (আ.)-কে সৃষ্টির পর বলেন যাও! ফেরেশতাদের ওই দলকে সালাম দাও এবং খেয়াল করে শোনো- তারা তোমার সালামের কী জবাব দেয়; কারণ এটিই হবে তোমার এবং তোমার বংশধরের সালাম-অভিবাদন। তখন আদম (আ.) বলেন, আসসালামু আলাইকুম। ফেরেশতারা জবাবে বলেন, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ (ফেরেশতারা ওয়া রাহমাতুল্লাহ বাড়িয়ে বললেন)। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৩২৬; মুসিলিম, হাদিস : ২৮৪১)
মোটকথা, সালামের এ শব্দ-বাক্য আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকেই এসেছে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যখন তোমরা ঘরে ঢুকবে নিজেদের লোকদের সালাম করবে কারণ এটা সাক্ষাতের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে প্রদত্ত বরকতপূর্ণ ও পবিত্র দোয়া।’ (সুরা নুর, হাদিস : ৬১)
উপরোক্ত বর্ণনায় দেখা গেছে, আদম (আ.)-এর উত্তরে ফেরেশতারা ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বাড়িয়ে বললেন- এ আদব আল্লাহতায়ালাই শিখিয়েছেন। যেমনটি আমরা ওপরে সুরা নিসার ৮৬ নম্বর আয়াত থেকে জানা গেছে। আর এ বাড়িয়ে বলার ফজিলতও বর্ণিত হয়েছে হাদিস শরিফে। ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) বলেন, ‘একবার এক ব্যক্তি এসে রাসুল (সা.)-কে সালাম দিল, ‘আসসালামু আলাইকুম’। তখন মহানবী (সা.) বলেন, আশ্র (দশ)। অর্থাৎ সে দশ নেকি লাভ করেছে।
আরেক ব্যক্তি এসে সালাম দিয়ে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’। এবার মহানবী (সা.) বললেন, ইশরুন (বিশ)। অর্থাৎ সে বিশ নেকি লাভ করেছে।
আরেক ব্যক্তি এসে সালাম দিয়ে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’। এবার নবীজি (সা.) বললেন, সালাসুন (ত্রিশ)। অর্থাৎ সে ত্রিশ নেকি লাভ করেছে। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৬৮৯)
তাই আমরাও যখন সালাম দেব, তখন পূর্ণ সালাম দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। এতে ত্রিশ নেকি লাভ হবে। পাশাপাশি পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেওয়ার চেষ্টা করব। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, এক লোক রাসুল (সা.)কে জিজ্ঞেস করল- ইসলামের কোন আমলটি (আমার জন্য) উত্তম? রাসুল (সা.) বললেন, ‘(ক্ষুধার্তকে) খাবার খাওয়াবে এবং পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১২; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৯)
রাসুল (সা.) তার সাহাবিদের সাতটি অসিয়ত করেছিলেন, যেন তারা সামাজিক জীবনে তা আঁকড়ে থাকেন। তাদের পরে উম্মতে মুসলিমাও যেন তা ধরে রাখে। তার মধ্যে একটি হলো সালাম। বারা ইবনে আজেব (রা.) সেই সাতটি বিষয় বর্ণনা করছেন। তিনি বলেন, তিনি আমাদের (সাতটি বিষয় পালনের) আদেশ দিয়েছেন রোগীর খোঁজখবর নেওয়া, জানাজার পেছনে চলা, হাঁচিদাতার জবাব দেওয়া (ইয়ার হামুকাল্লাহ বলা), দুর্বলকে সহযোগিতা করা, নির্যাতিতকে সাহায্য করা, সালামের প্রসার ঘটানো, কসমকারীকে (কসম থেকে) মুক্ত করা (সহায়তা করা)।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬২৩৫
রাসুল (সা.) সালামের প্রচলনকে অপরিসীম গুরুত্ব দিয়েছেন। সালাম বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করেছেন। হাদিসের গ্রন্থাদিতে একটি বড় অংশ জুড়ে আছে সালামের বিবরণ। সালাম প্রচলনের ফলে মুমিনদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। তাদের হৃদয়ের বন্ধন হয় দৃঢ় ও অটুট। তিনি বলেন, ‘তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না ইমান আনবে। আর তোমরা ততক্ষণ পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না পরস্পরকে মহব্বত করতে পারবে? আমি কী তোমাদের এমন কিছুর কথা বলে দেব, যার মাধ্যমে তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসবে। তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামের প্রসার ঘটাও।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৪)
সালামের আরও কিছু আদব রয়েছে। কে কাকে সালাম দেবে? ছোট বড়কে, নাকি বড় ছোটকে। পায়ে হেঁটে চলা ব্যক্তি আরোহীকে, নাকি আরোহী পায়ে চলা ব্যক্তিকে। বসা ব্যক্তি পথিককে সালাম দেবে, নাকি পথিক বসা ব্যক্তিকে। ছোট জামাত বড় জামাতকে, নাকি বড় জামাত ছোট জামাতকে ইত্যাদি।
আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত বিভিন্ন হাদিসে এ আদবগুলো পাওয়া যায়। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আরোহী ব্যক্তি পায়ে হেঁটে চলা ব্যক্তিকে সালাম দেবে। হেঁটে চলা ব্যক্তি সালাম দেবে বসে থাকা ব্যক্তিকে। অল্প মানুষের জামাত বেশি মানুষের জামাতকে সালাম দেবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬২৩২)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আরেক হাদিসে এসেছে, ‘বয়সে ছোটজন বড়জনকে সালাম দেবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬২৩১)
তবে বড়দেরও উচিত ছোটদের সালাম দেওয়া। যাতে করে তাদের মধ্যে সালামের অভ্যাস গড়ে ওঠে। সাইয়ার বর্ণনা করেন, ‘আমি ছাবেত আল-বুনানি (রাহ.)-এর সঙ্গে হাঁটছিলাম। তিনি কিছু শিশুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের সালাম দিলেন এবং বললেন, তিনি আনাস (রা.)-এর সঙ্গে হাঁটছিলেন। তিনি কিছু শিশুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সালাম দিলেন এবং বললেন, তিনি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে হাঁটছিলেন। তিনি কিছু শিশুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের সালাম দিয়েছেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২১৬৮)
ঘরে প্রবেশের সময় সালাম দেওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা হলো ঘরে ঢুকে কোমল ও নিচুস্বরে সালাম দেবে। বিশেষ করে অনেক রাতে যখন ঘরে ঢুকবে তখন এমন কোমল ও নিচুস্বরে সালাম দেবে, যেন যারা জেগে আছে তারা শুনতে পায় এবং যারা ঘুমে আছে তারা জেগে না ওঠে। রাসুল (সা.) এমনই করতেন। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘… তিনি রাতে ঘরে এসে এমনভাবে সালাম দিতেন, যাতে ঘুমন্ত ব্যক্তিরা জেগে না যায় এবং জাগ্রতরা শুনতে পায়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২০৫৫)
ইসলামে সালাম এতটাই গুরুত্বের দাবি রাখে যে, সালামের আদব, সালামের জবাব দেওয়ার আদব পবিত্র কোরআনে কারিমে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা শিখিয়েছেন। এ থেকেও আমরা মুসলিমের জীবনে সালামের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি।
আর যার মাঝে সালামে অভ্যাস থাকে তার মাঝে অহংকার নামোক জিনিসটা থাকে না তাই ছোট-বড়, ধনি-গরীব, উচু-নিচু সবাইকে সালামের অভ্যাস করি।