আভিধানিক অর্থ:
আক্বীদা শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলঃ বাধা, গিরা, বন্ধন, সম্পর্ক স্থাপন করা বা শক্তভাবে আকড়ে ধরা, অথবা কোন কিছুকে সাব্যস্ত করা বা শক্তিশালী হওয়া।
পারিভাষিক অর্থ :
সাধারণভাবে সেই সুদৃঢ় বিশ্বাস ও অকাট্য কর্মধারাকে আক্বীদা বলা হয় যার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী ব্যক্তির মনে সামান্যতম সন্দেহের অবকাশ থাকে না। আর ইসলামী আক্বীদা বলতে বুঝায়- আসমান-যমীন ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর যিনি সৃষ্টিকর্তা সেই মহান প্রভুর প্রতি সুনিশ্চিত বিশ্বাস স্থাপন করা, তাঁর উলূহিয়্যাত, রুবূবিয়্যাত ও গুণবাচক নামসমূহকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা। তাঁর ফেরেশতামন্ডলী, নবী-রাসূলগণ, তাঁদের উপর নাযিলকৃত কিতাবসমূহ, তাক্বদীরের ভাল-মন্দ এবং বিশুদ্ধ দলীল দ্বারা প্রমাণিত দ্বীনের মৌলিক বিষয়সমূহ ও অদৃশ্য বিষয়াদি সম্পর্কিত সংবাদসমূহ ইত্যাদি যে সব বিষয়াদির উপর সালাফে ছালেহীন ঐক্যমত পোষণ করেছেন তার প্রতি সুনিশ্চিত বিশ্
আল্লাহর নাযিলকৃত যাবতীয় আহকাম-নির্দেশনার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন এবং রাসূল (ছা:)-এর প্রচারিত শরী‘আতের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণ নিশ্চিত করা ইসলামী আক্বীদার অন্তর্ভুক্ত
সংক্ষেপে মানুষের দৃঢ় বিশ্বাসকে আক্বীদাহ বলে; যেখানে কোন সন্দেহ থাকে না এবং এর ভিত্তিতেই মানুষের জীবন বিধান চলে। যেহেতু প্রতিটি মানুষ তার গভীরতম বিশ্বাসের সাথে বাঁধা, অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ যা কিছু করে সবই তার বিশ্বাসের আলােকে করে, তাই মানুষের দৃঢ়তম বিশ্বাসকেই আক্বীদাহ্ বলে।
যেমনঃ ১ লাখ টাকা দিলে একজন হিন্দু যেমন মক্কায় যেয়ে হাজ্জ্ব করবে না তেমনি একজন প্রকৃত মুসলিম কোন মুর্তির সামনে মাথা নত করবে
আক্বীদাহ্ দুই প্রকার। যথা- সহীহ্ আক্বীদাহ ও বাত্বিল আক্বীদাহ্।
সহীহ্ আক্বীদাহ ও বাত্বিল আক্বীদাহ
যে আক্বীদার পক্ষে কুরআন এবং হাদীসের দালীল আছে তাকে সহীহ্ আক্বীদাহ বলে এবং যে আক্বীদার পক্ষে কুরআন এবং হাদীসের দালীল নেই তাকেই বাত্বিল আক্বীদাহ বলে। উল্লেখ্য যে, সহীহ্ আক্বীদাহকেই ইসলামী আক্বীদাহ বলে।
ইসলামী আক্বীদাহ তথা সহীহ্ আক্বীদাহ
এ সম্পর্কে শাইখ সালিহ আল ফাউযান (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন: “ইসলামী আক্বীদাহ হল, সেই চেতনা ও বিশ্বাসের নাম যা দিয়ে আল্লাহ তা'আলা নাবী-রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। নাযিল করেছেন অনেক আসমানী কিতাব।
দালীলঃ
মহান আল্লাহ সমগ্র মানুষ ও জ্বীন জাতির উপর সেই বিশ্বাস পােষণ করা অপরিহার্য করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেনঃ
وَمَا خَلَقۡتُ الۡجِنَّ وَالۡاِنۡسَ اِلَّا لِيَعۡبُدُوۡنِ , مَاۤ اُرِيۡدُ مِنۡهُمۡ مِّنۡ رِّزۡقٍ وَّمَاۤ اُرِيۡدُ اَنۡ يُّطۡعِمُوۡنِ
“এবং আমি জ্বীন ও মানুষ জাতিকে শুধুমাত্র আমার ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের নিকট কোন জীবিকা চাইনা এবং চাইনা যে তারা আমাকে খাদ্য দান করুক।”- (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬-৫৭)
তিনি আরও বলেনঃ
وَقَضٰى رَبُّكَ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّاۤ اِيَّاهُ
“এবং তােমার প্রতিপালক চূড়ান্ত ফায়সালা দিয়েছেন যে, তােমরা তাঁর ছাড়া আর কারও ইবাদাত করবে না।” - (সূরা ইসরাঃ ২৩)
وَلَـقَدۡ بَعَثۡنَا فِىۡ كُلِّ اُمَّةٍ رَّسُوۡلًا اَنِ اعۡبُدُوا اللّٰهَ وَاجۡتَنِبُوا الطَّاغُوۡتَۚ
“এবং আমি প্রত্যেক জাতির নিকট এ মর্মে রাসূল পাঠিয়েছে যে,তােমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং ত্বাগুত (তথা আল্লাহ ছাড়া যে সকল জিনিসের ইবাদাত করা হয়) সেগুলাে থেকে দূরে থাক।”- (সূরা আন নাহলঃ ৩৬)
উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, সমস্ত নাবী-রাসূল এ আক্বীদার আহ্বান নিয়ে পৃথিবীতে আগমণ করেছিলেন। সমস্ত আসমানী কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিল এ আক্বীদারই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার জন্য এবং এর বিপরীত সকল বাত্বিল বিশ্বাস ও ভ্রান্ত ধারণাকে অপনােদন করার জন্য। সৃষ্টি জগতের মধ্যে যাদের উপর শরীয়তের বিধান প্রযােজ্য হয় তাদের প্রত্যেককে এই আক্বীদাহ গ্রহণ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
আক্বীদার এত বেশি গুরুত্ব ও মর্যাদা সেটি সব কিছুর আগে সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে আলােচনা, পর্যালােচনা ও গবেষণা হওয়া প্রয়ােজন। সবচেয়ে বেশি দরকার এ ব্যাপারে জ্ঞানার্জন করা। কারণ, এর উপরই মানব জাতির দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্য ও সাফল্য নির্ভর করছে। আক্বীদার জ্ঞান ব্যাতিরেকে কোন ব্যক্তি প্রকৃত মুসলিম হতে পারে না ।
কোন অবকাঠামো যেমন ভিত্তি ছাড়া অকল্পনীয়, তেমনভাবে একজন মুসলিমের জীবনে আক্বীদা ও বিশ্বাসের দর্শন এমনই একটি অপরিহার্য বিষয় যা ব্যতীত সে নিজেকে মুসলিম হওয়ার অধিকার ও দাবী হারিয়ে ফেলে। এটা এমন এক অতুলনীয় শক্তির আঁধার যা একজন মুসলমানকে তার আদর্শের প্রতি শতভাগ আস্থাবান করে তুলে এবং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সেই বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটাতে বিরামহীনভাবে সচেষ্ট
অপরপক্ষে মানবজগতের যাবতীয় পথভ্রষ্টতার মূলে রয়েছে এই মৌলিক আক্বীদা থেকে বিচ্যুত হওয়া। এজন্য একজন মুসলমানের জন্য আক্বীদা-বিশ্বাসের ব্যাপারে সুস্পষ্ট জ্ঞান রাখা এবং সে বিশ্বাসের যথার্থতা নিশ্চিত করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বিশ্বাসের বিশুদ্ধতা ব্যতীত কোন ব্যক্তি প্রকৃত অর্থে মুসলিম হতে পারে না। প্রতিটি কথা ও কর্ম যদি বিশুদ্ধ আক্বীদা ও বিশ্বাস থেকে নির্গত না হয় তবে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ ব“যে ব্যক্তি বিশ্বাসের বিষয়ে অবিশ্বাস রাখে তার শ্রম বিফলে যাবে এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্থ হবে” [ সূরা মায়েদা – ৫তিনি আরো বলেন,
“(হে নবী!) তোমাকে এবং তোমার পূর্বসূরিদের আমি প্রত্যাদেশ করেছি যে, যদি তুমি আমার শরীক স্থাপন কর তবে তোমার যাবতীয় শ্রম বিফলে যাবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে” [ সূরা যুমার ৬৫]
মানুষ যুগে যুগে পথভ্রষ্ট হয়েছে মূলতঃ আক্বীদার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ঘটার কারণে। এজন্য বিষয়টি সূক্ষ্মতা ও সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে জানা অপরিহার্য।
আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা বলেনঃ
فَمَنۡ يَّكۡفُرۡ بِالطَّاغُوۡتِ وَيُؤۡمِنۡۢ بِاللّٰهِ فَقَدِ اسۡتَمۡسَكَ بِالۡعُرۡوَةِ الۡوُثۡقٰى لَا انْفِصَامَ لَهَا
“সুতরাং যে ত্বাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করল সে যেন শক্ত হাতল মজবুতভাবে ধারণ করল যা বিচ্ছিন্ন হওয়ার নয়।” - (সূরা বাকারাঃ ২৫৬)
এ কথার মানে হল, যে এ আক্বীদাহ হতে হাত গুটিয়ে নিবে সে অলীক-কল্পনা ও ভ্রান্ত বিশ্বাসকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে। কারণ, সঠিক পথ ছেড়ে দিলে সেখানে গােমরাহী ছাড়া অন্যকিছু থাকতে পারেনা। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
ذٰ لِكَ بِاَنَّ اللّٰهَ هُوَ الۡحَـقُّ وَاَنَّ مَا يَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِهٖ هُوَ الۡبَاطِلُ
“তা এ জন্যে যে, আল্লাহই তাে প্রকৃত সত্য আর তাঁকে ছাড়া ওরা যা কিছু আহবান করে তা ভ্রান্ত।”- (সূরা হজ্জঃ ৬২)
[উৎস: ইরশাদ ইলা সহীহ্িল ইতিকাদ, লেখক: শাইখ আল্লাম সালিহ আল ফাউযান]
ঈমান-আক্বীদাহ শুদ্ধ না হলে ছালাত-ছিয়াম সহ কোন ইবাদই আল্লাহর নিকট গ্রহনীয় হবে না। যেমন কেউ যদি শির্কী আক্বীদাহ পােষণ করে তাহলে যত ইবাদাতই করুক না কেন সব কিছুই বিফলে যাবে। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনلَـئِنۡ اَشۡرَكۡتَ لَيَحۡبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُوۡنَنَّ مِنَ الۡخٰسِرِيۡنَ
“যদি শির্ক করাে তবে তােমার সকল 'আমাল নিষ্ফল হবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে গণ্য হবে।”- (সূরা যুমারঃ ৬৫)
ঈমান, ইখলাস ও রাসুল (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অনুসরণ (যেগুলাে আক্বীদার মূল ভিত্তি) এর ক্ষেত্রে রুটি থাকবে আখিরাতে সকল নেককাজ ধুলিকনার মত অর্থহীন হয়ে যাবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন:وَقَدِمۡنَاۤ اِلٰى مَا عَمِلُوۡا مِنۡ عَمَلٍ فَجَعَلۡنٰهُ هَبَآءً مَّنۡثُوۡرًا
“আমি তাদের কৃতকর্মের নিকট আগমন করে সেগুলােকে উৎক্ষিপ্ত ধুলিকণায় পরিণত করব।”- (সূরা ফুরকানঃ ২৩)
ইসলামী আক্বীদাহ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য আবশ্যক। আক্বীদাহ বলতে কী বুঝায়, আক্বীদার উপর আর কী কী জিনিস নির্ভর করে, বিপরীত আক্বীদাগুলাে কী কী, কী কারণে আক্বীদাহ নষ্ট হয় বা তাতে কমতি সৃষ্টি হয় যমেন বড় শির্ক, ছােট শির্ক ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিটি মুসলিমের জানা বা শিক্ষা অর্জন করা অপরিহার্য। আল্লাহ বলেনঃ
فَاعۡلَمۡ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا اللّٰهُ وَاسۡتَغۡفِرۡ لِذَنۡۢبِكَ
“অতএব, জেনে রাখ যে আল্লাহ ছাড়া ইবাদাতের উপযুক্ত আর কেউ নাই। এবং তােমার গুনাহর জন্য তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর।”- সুরা মুহাম্মাদঃ ১৯
ইমাম বুখারী রাহ. সহীহ্ বুখারীতে একটি অধ্যায়ের শিরনাম রচনা করেছেন এভাবেঃ
بَابُ اْلعِلْمِ قَبْلَ الْقَوْلِ وَالْعَمَلِ
অধ্যায়ঃ "কথা বলা এবং 'আমাল করার আগে জ্ঞানার্জন করা"
এরপর তিনি এ শিরনামের স্বপক্ষে পূর্বোক্ত আয়াতটিকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছেন। উৎস: ইরশাদ ইলা সহীহ্িল ইতিকাদ, লেখক: শাইখ আল্লাম সালিহ আল ফাউযান,
উপরােক্ত আলােচনা থেকে প্রতিভাত হল যে, ঈমান ও আক্বীদাহ সঠিক না হওয়া পর্যন্ত অন্যান্য নেক 'আমালের কোনই মুল্য নাই। তাই 'আমাল সংশােধনের পূর্বে আক্বীদাহ সংশােধ করা এবং সে বিষয়ে জ্ঞানার্জন করা আবশ্যক। আল্লাহু আলাম।
আক্বীদার মূল ভিত্তি ৬টি
এগুলােকে ঈমানের রুকন বলা হয়।
আক্বীদার উৎস হলাে কুরআন ও সহীহ্ হাদীছ। কুরআন ও সহীহ্ হাদীছে নেই এমন কোন আক্বীদাহ গ্রহণ করা মুসলিমের জন্য জায়েয নেই।
সহীহ্ আক্বীদাহ তথা ইসলামী আক্বীদার উপকারীতা
আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তা বুঝা এবং বাস্তবায়ন করা সহজ হবে। ফলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন এবং জান্নাত দান করবেন, তাওহীদের উপর টিকে থাকা সহজ হবে এবং শির্ক থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে।