আল্লাহর অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর নাম এবং গুণাবলী রয়েছে যা তাঁর পরিপূর্ণতা এবং মহত্বের দালীল বহন করে।তাওহীদুল আসমা ওয়াসসিফাত হচ্ছে, এই নাম এবং গুনাবলীর প্রতি ঠিক সেইভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা যেভাবে পবিত্র কুরআন এবং হাদীসে সেগুলোর উল্লেখ রয়েছে; কোন প্রকার বিকৃতি, অস্বীকৃতি, ধরণ-গঠন বা সাদৃশ্য আরােপ না করে।
মহান আল্লাহ বলেন:
وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا
“আর আল্লাহর সুন্দর সুন্দর অনেকগুলো নাম আছে; তোমরা সেগুলো দ্বারা তাঁকে ডাক।” (সূরা আ'রাফ:১৮০,আরো দেখুন: আল ইসরা:১১০, সূরা ত্বাহা:০৮, সূরা হাশর: ২৪ ইত্যাদি)।
এই তাওহীদের ক্ষেত্রে সালফে সালেহীনদের নীতি
আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ
لَيۡسَ كَمِثۡلِهٖ شَىۡءٌ ۚ وَهُوَ السَّمِيۡعُ الۡبَصِيۡ
“কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।”- সূরা শূরা: ১১
এই আয়াতে কোন বস্তু তাঁর অনুরূপ না হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা- এই গুণরাজী তাঁর জন্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। আর এটাই হলাে সালফে সালেহীন তথা সাহাবায়ে কেরাম তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনগণের নীতি বা আক্বীদাহ-বিশ্বাস। কুরআন ও সাহিহ হাদীসে আল্লাহর যেসকল নাম ও গুনের উল্লেখ করা হয়ছে, তাঁরা কোন ধরনের পরিবর্তন, ধরন উল্লেখ বা সাদৃশ্য ব্যাতিরেকেই সেগুলোর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। অর্থাৎ তাঁরা সকলেই আল্লাহর নাম ও গুণরাজীর ব্যাপারে রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর শিখানাে পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
কুরআন-সুন্নাহর বাইরে আল্লাহর জন্য নাম বা গুণাবলী নির্ধারন
আল্লাহ্ তা'আলা নিজের জন্য যে নাম ও গুণরাজী পছন্দ করেছেন বা তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে নাম ও গুণরাজী তাঁর হাদীসে উল্লেখ করেছেন তা ব্যতীত অন্য কোন নাম বা গুণাবলী আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা যাবে না। কেননা আল্লাহ সম্পর্কে তিনি ব্যতীত কেউই অধিক জ্ঞানী নয়। এমনিভাবে আল্লাহর পর তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাড়া আল্লাহ্ সম্পর্কে অধিক জ্ঞানের অধিকারী আর কেউ নেইসুতরাং যে ব্যক্তি নির্দিষ্ট নাম ব্যতীত আল্লাহর জন্য অন্য কোন নাম স্থির করে বা সেগুলোর কোনটা অস্বীকার করে বা সৃষ্টি জীবের সাথে তাঁর সাদৃশ্য আরােপ করে বা সেগুলোর কোন একটিকে বিকৃত করে, কোন প্রকার ব্যাখ্যা করে তাহলে সে মূর্খতাবশতঃ আল্লাহর উপর মিথ্যারােপ করল। আল্লাহ বলেনঃ
فَمَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَـرٰى عَلَى اللّٰهِ كَذِبًا ؕ
“যে আল্লাহর উপর মিথ্যারােপ করে, তার চাইতে অধিক অত্যাচারী (গােনাহগার) আর কে?”- সূরা কাহাফ: ১৫
১। নাম
الرحمان - পরম করুণাময়(আর-রহমান), ارحيم - পরম দয়ালু(আর-রাহীম),
القادر - ক্ষমতাবান(আল-ক্ব-দির), اسامع - সর্বশ্রোতা(আস-সা-মি’),
القدير - মহাক্ষমতাধর(আল-ক্বদীর), البصير - সর্বদ্রষ্টা(আল-বাছীর),
القدوس - অতি পবিত্র(আল-কুদ্দূছ), الملك - মালিক(আল-মালিক)
السلام - পরম শান্তিদাতা(আস-সালা-ম) المؤمن - নিরাপত্তা দানকারী(আল-মু’মিন)
المهيمن - রক্ষাকারী(আল-মুহাইমিন) العزيز - পরাক্রমশালী(আল-আজীজ)
الجبار - মহা শক্তিধর(আল-জাব্বা-র) المولى - অভিভাবক(আল-মাওলা)
ইত্যাদি।
২। গুণরাজী বা ছিফাত
العُلُوُّ - সূমহান/সুউচ্চ, السَّمْعُ - শ্রবণ করা/শোনা, البَصَرُ - দেখা, القُدْرَةُ - ক্ষমতা,
الوَجْهُ - মুখমণ্ডল, اليَدُ - হাত, ُالرَحْمَة - দয়া العِلْمُ - জ্ঞান ُالقُوَّة - শক্তি, الغَضَبُ - রাগান্বিত হওয়া النُّزُوْلُ - অবতরন করা الإرَادَةُ - ইচ্ছে করা
৩। আল্লাহর নাম, কর্ম ও সত্ত্বাগত কিছু হ্যাঁ বোধক ছিফাত বা গুনাবলী
غفور আল্লাহ ক্ষমাশীল(নাম), আর ক্ষমা হলো ছিফাত বা গুণ। অনুরুপ.....
البصير আল্লাহ সর্বদ্রষ্টা(নাম), আর দেখা-ছিফাত বা গুণ।
السميع আল্লাহ সর্বশ্রোতা(নাম), আর শোনা বা শ্রবন হচ্ছে ছিফাত।
العدل আল্লাহ ন্যায়বিচারক, আর ন্যায়বিচার হলো ছিফাত আল্লাহর হাত, পা, মুখমন্ডল, চোখ, অন্তর ছিফাত (সত্ত্বাগত)
আল্লাহ হাসেন(কর্ম), আর হাসা ছিফাত (সত্ত্বাগত)
আল্লাহ কথা বলেন(কর্ম), আর কথা বলা ছিফাত (সত্ত্বাগত)
আল্লাহ অবতরণ করেন(কর্ম), আর অবতরন ছিফাত
আল্লাহ অসীম ক্ষমতার অধিকারী / ক্ষমতা ছিফাত
আল্লাহ দয়াশীল(নাম), আর দয়া, অনুগ্রহ, রহমত হচ্ছে ছিফা আল্লাহ প্রজ্ঞাময়(নাম), আর প্রজ্ঞা বা জ্ঞান, ইলম হচ্ছে ছিফাত আল্লাহ শান্তি দাতা(নাম), আর শান্তি হচ্ছে ছিফাত
আল্লাহ রাগ করেন বা ক্রোধান্বিত হন (কর্ম), আর গাদাব বা রাগ বা ক্রোধ হচ্ছে ছিফাত
আল-হাই(নাম), আর হায়াত বা জীবন হচ্ছে ছিফাত (সত্ত্বাগত) নাফস বা অন্তর (সত্ত্বাগত)
ইরাদাহ বা ইচ্ছা,
আল উলু العلو বা সুউচ্চ,
استوى সমুন্নত হয়েছন(কর্ম), আর সমুন্নত হচ্ছে ছিফাত সন্তুষ্টি বা الرضى
অসন্তুষ্টি বা السخط
আখিরাতে জান্নাতিগণ আল্লাহকে দেখবেন ইত্যাদি।
৪। আল্লাহর নাম, কর্ম ও সত্ত্বাগত কিছু না বোধক ছিফাত বা গুনাবলী
তিনি জন্ম দেননি, তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি। তিনি জালিম নন।
তিনি টেরা চোখ বিশিষ্ট নন।
ঘুম ও তন্দ্রা তাঁকে স্পর্শ করে না।
কেউ তাঁকে পরিবেষ্টন করতে পারবে না।
দুনিয়াতে কেউ তাঁকে দেখতে পারবে না, ইত্যাদি।
১। التحريف - তাহরীফ
শাব্দিক অর্থ- কোন জিনিসকে তার স্থান থেকে সরিয়ে দেয়া, কোন মূল উক্তির মধ্যে শব্দগতভাবে বা অর্থগতভাবে পরিবর্তন করা। শাব্দিক পরিবর্তন হয়- শব্দের মধ্যে সংযােজোন বা তার আকৃতি বিকৃতির মাধ্যমে। যেমন আশআরী সম্প্রদায় ও তাদের অনুসারী বিদ'আতীগণ আল্লাহর বাণী اَلرَّحۡمٰنُ عَلَى الۡعَرۡشِ اسۡتَوٰى “মহান আল্লাহ আরশে সমুন্নত”- (সূরা ত্বাহা: ৫) এর মধ্যে اسۡتَوٰى শব্দকে পরিবর্তন করে استولى বলে থাকেআর আর্থিক পরিবর্তন হলাে- শব্দকে স্বীয় অবস্থায় রেখে তার সঠিক অর্থ না করে বাত্বিল অর্থ গ্রহণ করা। যেমন- اليدين বা “দুই হাত” যা আল্লাহর দিকে সম্বন্ধযুক্ত, এর মূল অর্থ পরিত্যাগ করে শক্তি’ বা ‘নিআমাত’ বা ‘পুরস্কার' ইত্যাদি অর্থ গ্রহণ করা।
২। التعطيل - তাতীল
তা হল- যে সকল নাম বা গুণরাজী আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট, তা অস্বীকার করা বা তার কোন একটি অমান্য করা। যেমন- আল্লাহর গুণাবলীর মধ্যে কথা বলা, আসা, দেখা ইত্যাদি অস্বীকার করা বা তার কোন একটি প্রত্যাখ্যান করা।
৩। التكييف - তাকয়ীফ
তা হলাে কোন বস্তুর ধরণ-গঠন নির্দিষ্ট করা। বা তার অবস্থার বর্ণনা দেয়। যেমন- কেহ কেহ বলে থাকে- আল্লাহ্র “হাত” বা তার “অবতরণ” এরূপ... এরূপ...।
| এ ধরণের মন্তব্য ঠিক নয়। কেননা আকৃতির বিবরণ তাে কুরআন-হাদীসে উল্লেখ হয়নি। সুতরাং সে ব্যাপারে কোন মন্তব্য না করে যেভাবে শব্দগুলাে কুরআন-হাদীসে এসেছে ঠিক সেভাবেই তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে।
৪। التمثيل - তামছীল
তামছীল হলো কোন বস্তুর নমুনা নির্দিষ্ট করা, মানে উদাহরণ দেয়া। التمثيل শব্দটি দুটি বস্তুর একটি নমুনা নির্দিষ্ট করে, আর তা হলাে উভয়ে সকল দিক থেকে এক সমান বা বরাবর হওয়া।
৫। التشبيه - তাশবীহ্
কোন বস্তুর সদৃশ সাব্যস্ত করাকে তাশবীহ বলা হয়। যেমন- লোকটা যেন বাঘ! এখানে লোকটির বাঘের মতন পা নাই কিন্তু হয়তো বাঘের ক্ষিপ্রতাকে সাদৃশ্য করা হচ্ছে। التشبيه শব্দটি পারস্পরিক তুলনা করা অর্থে ব্যবহার হয়। আর তা হলাে উভয়ে অধিকাংশ গুণাবলীতে বরাবর হওয়া।কারও মধ্যে এই পাঁচটি বিষয়ের কোন একটি পাওয়া গেলেই তার তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাতের ভিত্তি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে সঠিক নীতি হলো, আল্লাহর জন্য যেমন প্রযোজ্য ও শোভনীয়, আল্লাহর নাম ও গুণাবলীসমূহ ঠিক তেমনি সাব্যস্ত করা।
মহান আল্লাহ বলেনঃ
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
“তাঁর মত কোন কিছূ নেই, তিনি সর্ব শ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা।”(সূরা শূরা/১১)
আল্লাহর উত্তম নামসমূহ তাঁর পরিপূর্ণ গুণাবলীর প্রমাণ বহন করে। এই পবিত্র নামগুলাে নিছকই নাম নয়, যে তার কোন অর্থ নেই; বরং তা একদিকে সম্মানিত নাম যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থ সম্বলিত এবং অপরদিকে তাঁর মহান গুণরাজীর সাক্ষ্য বহন করে।
প্রতিটি নাম এক একটি গুণের অধিকারী। যেমন-
الرحمان (রাহমান), الرحيم (রাহীম) নাম দুটি “রহমত” নামক বিশেষণের অধিকারী।
السميع والبصير নাম দু’টি যথাক্রমে শ্রবণ করা এবং দেখা- বিশেষণ যুক্ত।
العليم “মহাজ্ঞাণী” নামটি এমন জ্ঞানের অধিকারী যা প্রত্যেক বস্তু ব্যপৃত।
الكريم “মহা সম্মনিত” নামটি সম্মান নামক বিশেষণে যুক্ত।
الخالق “স্রষ্টা” শব্দটি সৃষ্টি করা বিশেষণের দাবিদার ও
الرزاق “রিজিক দাতা” নামটি রিজিক দেয়া বিশেষণের দাবিদার।
এমনিভাবে প্রতিটি নাম সেই নামের মধ্যে নিহিত বিশেষণের পরিপুর্ন দাবি রাখে।
আল্লাহর নাম ও গুনাবলির মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলো- আল্লাহর নাম থেকে গুণ বের করা যাবে, কিন্তু গুণ থেকে আল্লাহর নাম বের করা যাবে না। যেমন আল্লাহর নাম ‘আর-রহমান’ যার অর্থ ‘অতি দয়ালু’ তাই তাঁর মধ্যে দয়ার গুণ রয়েছে, এটা বলা যাবে। কিন্তু আল্লাহর একটি গুণ হল ‘গাদব’ যার অর্থ ‘রাগান্বীত হওয়া’ তাই বলে তাঁকে গাদেব বা ‘রাগান্বীত’ নাম দেয়া যাবে আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞান লাভ এবং সেগুলোর প্রতি ঈমান আনার উপকারীতা ও প্রভাব
১। বান্দার প্রতিপালকের প্রকৃত পরিচয় লাভ
কোন বান্দার পক্ষে তার প্রতিপালকের প্রকৃত পরিচয় লাভের কোনই পথ নেই- তাঁর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞান লাভ ব্যতীত।
এ ব্যাপারে অসংখ্য প্রমাণাদী রয়েছে; বরং বলা যায়, আল কুরআন পুরাটাই আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে কথা বলে। এ থেকেই জানা যায়, ঐ সমস্ত লােকদের ভয়াবহ পাপাচার ও দুস্কৃতির পরিচয় যারা আল্লাহর নাম ও গুণাবলী এবং তাঁর কাজ-কর্ম ইত্যাদিকে সম্পূর্ণ রূপে বা তার কিছু অংশ অস্বীকার করে। কেননা, তারা এর মাধ্যমে আল্লাহর পরিচয় লাভের দরজা বন্ধ করে দিতে চায়। কোন অস্তিত্বপূর্ণ সত্ত্বা বা বস্তুর নাম, গুণাবলী বা কর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা না করারই দাবী রাখে, যাতে তা থেকে কোন উপকার অর্জন সম্ভব না হয়।
২। ঈমানের পূর্ণতা লাভ
ইলম বা জ্ঞান এবং 'আমাল বা কর্মের মাধ্যমেই ঈমান পূর্ণতা লাভ করে বা তাতে ঘাটতি হয় অর্থাৎ ঈমান কম-বেশী হয়। বান্দা যখন আল্লাহ সম্পর্কে বা তাঁর নির্দেশাবলী সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে তখন তার ঈমান বৃদ্ধি পায়। আবার জ্ঞান এবং কর্মের ঘাটতি হলে ঈমানেরও ঘাটতি দেখা দেয়।
আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
وَ اِذَا مَاۤ اُنۡزِلَتۡ سُوۡرَۃٌ فَمِنۡہُمۡ مَّنۡ یَّقُوۡلُ اَیُّکُمۡ زَادَتۡہُ ہٰذِہٖۤ اِیۡمَانًا ۚ فَاَمَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا فَزَادَتۡہُمۡ اِیۡمَانًا وَّ ہُمۡ یَسۡتَبۡشِرُوۡنَ ﴿۱۲۴﴾ وَ اَمَّا الَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ مَّرَضٌ فَزَادَتۡہُمۡ رِجۡسًا اِلٰی رِجۡسِہِمۡ وَ مَا تُوۡا وَ ہُمۡ کٰفِرُوۡنَ ﴿۱۲۵﴾
“আর যখন কোন সূরা অবর্তীর্ণ হয়, তখন তাদের কেউ কেউ বলে, এ সূরা তােমাদের মধ্যে কার ঈমান কতটা বৃদ্ধি করলাে? অতএব যারা ঈমানদার, এ সূরা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়েছে। বস্তুতঃ যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। এটি তাদের কলুষতার সাথে আরাে কলুষতা বৃদ্ধি করেছে। এবং তারা কাফির অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করল।”- সূরা-তওবা ১২৪, ১২৫
৩। বিশেষ পুরস্কার লাভ
আল্লাহর নাম সমূহের সংরক্ষণকারী (মুখস্তকারী), অর্থ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ কারী এবং সেগুলোর দাবী অনুযায়ী 'আমালকারী এমন পুরস্কারে ভূষিত হবে যে সম্পর্কে আল্লাহ্ ছাড়া কেউ অবগত নয়।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃإن لله تسعة وتسعين اسما مائة إلا واحدا من أحصاها دخل الجنة
“আল্লাহ তা'আলার নিরানব্বইটি (এক কম একশ) নাম রয়েছে, যে এগুলো গণনা করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। - (ছহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ শর্তআরােপ করা, অনুচ্ছেদ: স্বাকারােক্তি ও শর্তারােপের ক্ষেত্রে কি শর্ত ও ব্যতীক্রম করা যায় হা/ ২৫৩১। মুসলিম, অধ্যায়ঃ যিকির, দু’আ ও ইস্তেগফার, অনুচ্ছেদ: আল্লাহর নাম সমূহ ও তা মুখস্ত করার ফযীলত। হা/ ৪৮৩৬)
ইমাম নবুবী (রঃ) বলেন- ইমাম বুখারী (রঃ) সহ অন্যান্য নির্ভরযােগ্য মনীষিগণ বলেছেনঃ এখানে أحصاها বা গণনা করা মানে হলো মুখস্ত করা। এবং এই গননা করার আরেকটা ব্যাখ্যা হচ্ছে- আল্লাহর নাম সমূহ মুখস্ত করা, অর্থ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা এবং তার দাবী অনুযায়ী 'আমাল করা।
৪। বান্দার ইবাদাতের কর্মসূচী নির্ধারন সহজ হবে
যখন প্রমাণ হলাে যে, আল্লাহ তা'আলার নামসমূহ এবং গুণরাজী তাঁর মহত্ম, পূর্ণতা ও নেতৃত্বের দাবীদার, তখন সেটাই উত্তম পন্থা যার মাধ্যমে বান্দা তার ইবাদাতের কর্মসূচী নির্ণয় করতে পারে। যেমনঃ
এককভাবে আল্লাহকে সম্মান করা,
তাঁর পবিত্রতা ঘােষণা করাও প্রশংসা করা,
একনিষ্ঠভাবে তাঁকেই আহ্বান করা অর্থাৎ শুধু তারই নিকট প্রার্থনা করা, ইত্যাদি।
৫। বান্দার ইবাদাতের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব
নিঃসন্দেহে আল্লাহর প্রতিটি নাম এবং গুণাবলীতে বিশ্বাস স্থাপন বান্দার ইবাদাতে বিশেষ ধরণের প্রভাব ফেলে। যেমন-
❀ আল্লাহর ব্যপারে সতর্ক থাকা এবং তাঁকে যথাযথ ভয় করাঃ যখন সে জানবে যে, তার প্রভু কঠিন শাস্তি প্রদানকারী, তিনি রাগন্বিত হন, তিনি ক্ষমতাবান ও পরাক্রমশালী, যা ইচ্ছা তা-ই করেন, দেখেন, শােনেন, প্রত্যেক বস্তু সম্পর্কে তাঁর অগাধ জ্ঞান, কোন কিছুই তাঁর নিকট গােপন নয়, তখন এই বিষয়গুলাে তাকে উদ্বুদ্ধ করবে-আল্লাহর সদাদৃষ্টি সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকতে, তাঁকে ভয় করতে, যাবতীয় পাপাচার থেকে দূরে থাকতে, ইত্যাদি।
❀ আল্লাহর ব্যপারে সুধারনা পোষণ করা এবং আশাবাদী হওয়াঃ আবার যখন সে জানবে যে, আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, দয়ালু, সম্মানিত, বান্দার তওবায় খুশি হন এবং পাপরাশি মার্জনা করে দেন। তখন এ বিষয় গুলাে তাকে ধাবিত করবে- তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করার দিকে,
আল্লাহর প্রতি সুধারনা ও আশাবাদী হওয়ার দিকে, ইত্যাদি।
❀ আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়া ও তাঁর নৈকট্যের আকাংখা জন্মানোঃ যখন একথার জ্ঞান লাভ করবে যে, তার আল্লাহ অনুগ্রাহী, সকল প্রকার নেয়ামত দানকারী, তাঁর হাতেই যাবতীয় কল্যাণ, তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান, তিনি দান করেন, রিজিক দেন, সৎ কাজের পুরস্কার দেন আর মু'মিন বান্দাদিগকে সম্মানিত করেন, তখন এই বিষয়গুলাে-তার অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করবে,
বান্দাকে তাঁর নৈকট্য লাভে সচেষ্ট করবে,
তাকে ভালো কাজে পুরস্কার লাভের প্রত্যাশায় বেশী বেশী সৎ কর্ম করায় সচেষ্ট করবে,অপর মুসলিম ভাইয়ের কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী করবে, ইত্যাদি।
❀ আল্লাহর শাস্তির ভয় জন্মানো এবং তাঁর সৃষ্টির হক রক্ষায় গুরুত্ব দেওয়াঃ আবার যখন বুঝতে পারবে যে, নিঃসন্দেহে আল্লাহই ন্যায়পরায়ণ শাসক, তিনি অন্যায়-অত্যাচার, সীমালংঘন ও শ্ত্রুতা পছন্দ করেন না; বরং তিনি অত্যাচারী, সীমালংঘনকারী ও দুস্কৃতিকারীদের কঠোর শাস্তি দিয়ে প্রতিশােধ নিয়ে থাকেন, তখন স্বভাবতঃইসে সৃষ্টি জীবের প্রতি জুলুম-নির্যাতন থেকে বিরত থাকবে,
শত্রুতা, অবাধ্যতা, দুস্কর্ম, ধােকাবাজী, খিয়ানত ইত্যাদি পাপাচার থেকে দূরে থাকবে,
নিজের প্রতি ন্যায়পরায়ণ হবে,
মুসলিম ভাইদের সাথে সুন্দর আচরণ করবে, ইত্যাদি।
❀ আল্লাহর নাম ও গুনের ওয়াছিলায় দু’আ করাঃ বান্দা যখন আল্লাহর নামের অর্থ ও তার মধ্যে নিহিত গুনাবলী সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা লাভ করবে, তখন সে তার প্রয়োজনের সাথে সম্পর্কিত আল্লাহর নাম বা গুণাবলীর ওয়াছিলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু’আ করবে। মহান আল্লাহ ব وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا
আর আল্লাহর সুন্দর সুন্দর অনেকগুলো নাম আছে; তোমরা সেগুলো দ্বারা তাঁকে ডাক। (সূরা আ'রাফ:১৮০,আরো দেখুন: আল ইসরা:১১০, সূরা ত্বাহা:০৮, সূরা হাশর: ২৪ ইত্যাদি)।
আল্লাহর নাম ধরে আল্লাহকে ডাকতে হবে অর্থাৎ দুয়া করতে হবে। এতে দুয়া কবুল হওয়ার নিশ্চয়তা অধিক, যেহেতু আল্লাহ তা’আলা নিজেই তাঁকে এভাবে ডাকতে/দু’আ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে কুরআনে বা হাদীছে নেই এমন কোন নাম ধরে আল্লাহকে ডাকা যাবে এমনিভাবে আল্লাহর বান্দা যতই আল্লাহ্ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করবে, ততই সুন্দর ও প্রশংসিত আচরণে নিজেকে ভূষিত করতে পারবে।
আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে বক্রতা অবলম্বন
وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ فَادْعُوهُ بِهَا ۖ وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ ۚ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সব উত্তম নাম। কাজেই সে নাম ধরেই তাঁকে ডাক। আর তাদেরকে বর্জন কর, যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বাঁকা পথে চলে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল শীঘ্রই পাবে।” - (আল আরাফ - ১৮০)
তাফসীর আহসানুল বায়ানে বলা হয়েছে, আল্লাহর নামসমূহে বক্রপথ অবলম্বন করা তিনভাবে হতে পারে।
❌ আল্লাহর নামের পরিবর্তন করা, যেমন মুশরিকরা করত। উদাহরণ স্বরূপ মহান আল্লাহর সত্ত্বাগত নাম 'আল্লাহ' থেকে তারা তাদের এক মূর্তির নামকরণ করেছিল 'লাত', আল্লাহর গুণবাচক নাম, 'আযীয' হতে 'উয্যা' নামকরণ করেছিল।
❌ আল্লাহর নামে মনগড়া অতিরিক্ত সংযোজন করা, যার আদেশ তিনি দেননি।
❌ তাঁর নাম কম করে দেওয়া; যেমন, তাঁকে একটি নির্দিষ্ট নামেই ডাকা এবং অন্যান্য গুণবাচক নামে ডাকাকে খারাপ মনে করা। (ফাতহুল ক্বাদীর)
আল্লাহর নামসমুহে 'বক্রপথ অবলম্বন' করার একটি অর্থ এটাও হতে পারে যে, তার তা'বীল(অপব্যাখ্যা) করা অথবা তা অর্থহীন বা নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া অথবা তার উপমা বা সদৃশ বর্ণনা করা। (আয়সারুত তাফাসীর)এই আয়াতে আরো কয়েকটি লক্ষনীয় বিষয় রয়েছে, আল্লাহর অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে।আল্লাহকে তাঁর নামের ওসীলায় ডাকতে/দুয়া করতে বলা হয়েছে।
আল্লাহকে তাঁর নাম ধরে ডাকলে নিশ্চয় তিনি খুশি হন। কারণ তিনিই এই নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহকে তাঁর দেয়া নির্দিষ্ট নামগুলো ছাড়া অন্য কোন নামে ডাকা নিষেধ: যেমন খোদা, গড, ইশ্বর ইত্যাদি কিছু মানুষ আল্লাহকে বিকৃত নামে ডাকে, তা না হলে তিনি নিষেধ করলেন কেন। আল্লাহকে বিকৃত নামে ডাকার মানে হলো, কুরআন ও হাদীসে নেই এমন নামে আল্লাহকে ডাকা!
তাদেরকে বর্জন করতে হবে, যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বাঁকা পথে চলে। তাদের ওয়াজ শুনা, বয়ান শুনা, লিখনি পড়া, ফাতাওয়া ইত্যাদি সব কিছুই বর্জন করতে হ যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বাঁকা পথে চলে তাদেরকে তিনি কঠিন শাস্তি দিবেন।
আল্লাহর নামের ক্ষেত্রে বক্র পথ অবলম্বন করা কাবীরা গুণাহ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আল্লাহর আসমা ওয়াছ-ছিফাত সম্পর্কে তথা আল্লাহ সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ভুল বিশ্বাস ও তার জবাব
❌আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান
আল্লাহ সাত আসমানের উপরে, আরশের উপরে সমুন্নত। (দেখুন-সূরা ত্বাহা:০৫, সূরা মুলক:১৬,১৭) তবে তাঁর দৃষ্টি, জ্ঞান ও ক্ষমতা সর্বত্রই বিরাজমান। (সূরা ত্বাহা:৪৬)
❌আল্লাহ নিরাকার
জান্নাতে মু'মিনগণ আল্লাহকে দেখবে। (সূরা কাহাফ:১১০)
❌দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখা যায়
দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়। (সূরা আ’রাফ:১৪৩)
❌আল্লাহকে পেতে ওলীদের ওসীলা ধরা।
কোন ব্যাক্তির ওসীলা লাগে না, সরাসরি ডাকলেই আল্লাহকে পাওয়া যায়। (সূরা গাফের:৬০) আল্লাহকে পেতে নিষিদ্ধ ওসীলা ধরা শির্ক। (সূরা ইউনূস:১৮, যুমার:০৩)