এই প্রশ্নের উত্তর কি? প্রশ্নকারী যখন সয়ং আল্লাহ? আর প্রশ্নটি করছেন তিনি আমাকে, আপনাকে, আমাদেরকে, আমাদের সবাইকে! আল্লাহর প্রশ্নঃ
أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ
“তোমরা কি ধারণা করেছ যে, আমি তোমাদেরকে অযথাই সৃষ্টি করেছি? আর তোমরা আমার দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে না?” (সূরা মু'মিনূনঃ ১১৫)
আল্লাহ তো কোন কিছুই অযথা সৃষ্টি করেন না! আল্লাহ আমাদেরকেও অযথা সৃষ্টি করেননি! তাই আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যটা বলে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
“আমি জ্বীন এবং মানুষকে শুধুমাত্র আমার ইবাদাতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।” (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬)।
তাই ‘ইবাদাহ’ এমন এক গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, যার সাথে আমাদের এই পৃথীবিতে আগমনের উদ্দেশ্য জড়িত! এটি আমাদের জীবনের সাথে যুক্ত, এটি আমাদের উভয় জীবনের সাথে সম্পর্কিত। আর তা হলো ইবাদাহ বা দাসত্ব!
ইবাদাহ (العبادة) মানে দাসত্ব বা গোলামী করা। এই কথাটির মধ্যে নিচুতা ও আনুগত্যের বৈশিষ্ট মিশে আছে।
সংজ্ঞা বা পরিভাষায়
এমন সকল কথা ও কাজ করাকে ইবাদাহ বলে, যা আল্লাহ পছন্দ করেন এবং এর প্রতি তিনি সন্তুষ্ট হন। চাই তা প্রকাশ্য হোক বা গোপন।
ইবাদাত করার উপায়-উপকরন ভেদে এটিকে নিচের ৭ প্রকারে ভাগ করা যায়।
১। ক্বালবী ইবাদাত বা অপ্রকাশ্য ইবাদাত
যা শুধু অন্তর দিয়েই করা যায়। যেমন- ইমান, ইখলাস, আশা -আকাঙ্ক্ষা, ভয়-ভীতি, ইলম, আল্লাহকে ভালোবাসা,আল্লাহর জন্য ভালোবাসা, আল্লাহর জন্য ঘৃণা, আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা, আল্লাহমূখী হওয়া, ইত্যাদি।
২। মৌখিক ইবাদাত
যা করতে অন্তর ও ভাষার দরকার হয়। যেমন- কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ, দুয়া, যিকির, তাসবীহ, তিলাওয়াত, আযান, ইকামত, ওয়াজ-নসীহত, ভাল উপদেশ দেয়া, ভাল কথা, তালবিয়া পাঠ, দরূদ পাঠ ইত্যাদি।
৩। শারীরিক ইবাদাত
যা আদায় করতে অন্তরের সাথে শরীরও লাগে। যেমন- সলাত - রুকু, সিজদা, ক্বাওমা (দাড়ানো), তাওয়াফ, সাঈ, ছওম ইত্যাদি।
৪। আর্থিক ইবাদাত
যা করতে অন্তরের সাথে অর্থের প্রয়োজন হয়। যেমন- যাকাত, ফিতরা, কুরবানি, মান্নত, দান-সদাকা, ভিক্ষা- কর্জ, ইত্যাদি।
৫। এমন ইবাদাত যা করতে ক্বলব, মুখ, শরীর ও অর্থ (উপরের সবকিছুই) প্রয়োজন
যেমন : হাজ্জ্ব, জিহাদ ইত্যাদি।
৬। আল্লারহ ভয়ে হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা ইবাদাত
আল্লাহর ভয়ে হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা সাধারণ ইবাদাতের থেকে বড় ইবাদাত।
হাদিসে আছে ৭ শ্রেণীর লোককে আল্লাহ আরশের ছায়া দিবেন, তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হবেন তারা, যারা সুন্দরী নারীদের সাথে ব্যভিচার করার আমন্ত্রণ বা সুযোগ পেয়েও শুধু আল্লাহর ভয়ে বিরত থেকেছেন। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “তুমি আল্লাহর ভয়ে হারাম থেকে বিরত থাক, তাহলে সব থেকে বড় ইবাদাতকারীর মর্যাদা লাভ করতে পারবে।” (তিরমিযী/হাসান)
৭। দৈনন্দির জীবনে মু'মিনের প্রতিটি সাধারন কাজ-কর্ম ইবাদাত হিসেবে গণ্য হতে পারে
মু'মিনের প্রতিটি সাধারন মুবাহ কাজ-কর্ম যা সে নিত্যদিন নিজ প্রয়োজেনের জন্য করে থাকে তা-ও ইবাদাত হিসেবে গণ্য হতে পারে সৎ নিয়তের মাধ্যমে। অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি শক্তি অর্জন, আল্লাহর নাফারমানী থেকে বিরত থাকা এবং আল্লারহ নৈকট্যের পথে নিজেকে হেফাজাত করার মহৎ নিয়তের কারণে প্রতিটি দৈনন্দিন কাজ-কর্ম ইবাদাতের মর্যাদা লাভ করবে এবং এতে সে প্রতিদান পাবে। যেমন ঘুম, খাওয়া, চাকরী, বেচাকেনা, বিবাহ, রান্না-বান্না, পশু পালন, চাষাবাদ, লেখা-পড়া, ফেসবুক, হয়াটস্অ্যাপ ইত্যাদি।
রাসূল (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট দিয়ে এক ব্যক্তি অতিক্রম করল, সাহাবায়ে কেরাম লোকটির শরীর ও ততপরতা (শক্তিমত্ত্বা) দেখে মুগদ্ধ হলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! লোকটি যদি আল্লাহর পথে বের হতো তাহলে কতই না ভাল হতো!
রাসূল (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: সে যদি স্বীয় ছোট ছোট সন্তানদের পতিপালনের উদ্দেশ্যে বের হয়ে থাকে তাহলে সে আল্লাহর পথেই আছে। অনুরুপ, সে যদি নিজেকে পবিত্র রাখতে কর্মের (হালাল রুজি-রুটির) উদ্দেশ্যে বের হয়ে থাকে তবুও সে আল্লাহর পথেই আছে। কিন্তু সে যদি রিয়া এবং গরিমা ও অহংকার জাহির করার উদ্দেশ্যে বের হয়ে থাকে, তাহলে সে শাইত্বানের পথে চলছে। (ত্বাবারানী, সহীহ্ জামে:1428)
রাসূল (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন: (إنما الأعمال بالنيات) প্রতিটি কর্ম নিয়তের উপর নির্ভরশীল। (বুখারী-মুসলিম)
ইবাদাত মূলত তিনটি ক্ষেত্রে বিভক্ত, যথাঃ অন্তর, ভাষা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। নিচে এই ক্ষেত্রভেদে ইবাদাতের কিছু উদাহরন দেয়া হলো-
১। অন্তরের বা আত্মীক ইবাদাত
যেমনঃ ভয়, ভরসা, ভালোবাসা, আশা-আকাংখা, আগ্রহ ইত্যাদি হল আত্মীক ইবাদাত।
২। ভাষা ও অন্তরের ইবাদাত
যেমনঃ তাসবীহ পড়া (বা সুবহানাল্লাহ বলা), তাহলীল পড়া (বা লাইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা), প্রশংসা করা, শুকরিয়া (কৃতজ্ঞতা) করা।
৩। অন্তর ও দেহের ইবাদাত
যেমনঃ আর ছালাত, যাকাত, হাজ্জ্ব, জিহাদ ইত্যাদি হল- আত্মিক ও দৈহিক ইবাদাত।
এছাড়া আরাে অনেক ধরণের ইবাদাত রয়েছে, যা আদায়ের মাধ্যম হলাে, অন্তর, ভাষা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।