এ ব্যাপারে “হাদীছে জিবরীল” নামে খ্যাত হাদীছটি সর্বাধিক প্রযােজ্য।
ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- একদা আমরা মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। এমন সময় আমাদের সামনে এক ব্যক্তি উপস্থিত হলেন, তাঁর পােশাক ছিল ধধবে সাদা আর চুল ছিল কুচকুচে কালাে। দূর হতে ভ্রমণ করে আসার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছিল না তাঁর মধ্যে, আর তিনি আমাদের কারাে পরিচিতও নন। তিনি মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকটবর্তী হলেন, তাঁর হাঁটুতে স্বীয় হাঁটু লাগালেন এবং দুই হাত নিজ উরুর উপর রেখে বসে পড়লেন। অতঃপর বললেনঃ হে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে ইসলাম সম্বন্ধে জ্ঞান দান করুন।
উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ
“ইসলাম হচ্ছে (১) এই সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া (সত্যিকারের) কোন মা'বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর রাসূল। (২) ছালাত (নামায) কায়েম করা। (৩) যাকাত আদায় করা। (৪) রমাদ্বানে ছিয়াম (রােযা) পালন করা। (৫) সামর্থ থাকলে আল্লাহর ঘরের হাজ্জ্ব আদায় করা।” উত্তর শুনে তিনি বললেনঃ সত্য বলেছেন। আমরা অবাক হয়ে গেলাম। তিনি প্রশ্ন করেছেন, আবার উত্তরকে সত্য বলেছেন! তিনি আবার বললেনঃ আমাকে ঈমান সম্পর্কে কিছু বলুন। মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ “তা হল, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা (১) আল্লাহ পাকের উপর (২) তাঁর ফেরেস্তাদের উপর (৩) তাঁর কিতাব সমূহের উপর (৪) তাঁর রাসুলদের উপর (৫) আখিরাত বা শেষ দিবসের উপর এবং (৬) ক্বদরের ভাল-মন্দের উপর।” উত্তর পেয়ে তিনি বললেন- সত্য বলেছেন।
তিনি আবার প্রশ্ন করলেন- আমাকে ইহসান সম্পর্কে জ্ঞাত করুন। মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ “ইহসান হল, এমনভাবে তুমি আল্লাহ পাকের ইবাদাত করবে যেন তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। যদি তাঁকে দেখতে নাও পাও তবে (বিশ্বাস করবে যে,) তিনি তােমাকে অবশ্যই দেখছেন।”
অতঃপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন- কিয়ামত সম্বন্ধে বলুন। উত্তরে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ “প্রশ্নকারীর চাইতে জবাব দানকারী এ সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত নয়।” তিনি বললেন তবে তার নিদর্শন বা আলামত সম্বন্ধে কিছু বলুন। তিনি বললেনঃ “দাসী তার মনিবকে প্রসব করবে। দেখবে নগ্নপদ, নগ্ন (পােশাকহীন), ক্ষুধার্ত রাখালেরা উঁচু উঁচু দালান নির্মাণ করবে।” এরপর আগন্তক ব্যক্তি চলে গেলেন। অতঃপর আমি (ওমর) কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকলাম। মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে প্রশ্ন করলেনঃ হে ওমর! তুমি কি জান প্রশ্নকারী কে? আমি বললামঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জ্ঞাত আছেন। তিনি বললেনঃ ইনি ছিলেন জিবরীল ('আলাইহিস সালাম)। তিনি এসেছিলেন তােমাদেরকে দ্বীন শিক্ষা দিতে।- [ছহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ ঈমান, অনুচ্ছেদ: ঈমান, ইসলাম, ইহসান ও ঈমানের আবশ্যকতা। হা/ ৯]
মক্কা বিজয়ের পর পল্লীবাসী দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে নিজেদেরকে মু'মিন বলতে লাগলে আল্লাহ তা'আলা এই আয়াত নাযিল করলেনঃ
قَالَتِ الْأَعْرَابُ آمَنَّا قُلْ لَمْ تُؤْمِنُوا وَلَكِنْ قُولُوا أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ الْإِيمَانُ فِي قُلُوبِكُمْ
“পল্লীবাসী লোকেরা বলেছে আমরা মু'মিন হয়ে গেছি। আপনি বলুন- তোমরা মু'মিন হওনি, তোমরা বরং বল আমরা মুসলিম হয়েছি। তোমাদের হৃদয়ে এখনো ঈমান প্রবেশ করেনি”। (সূরা হুজুরাত:১৪)
অত্র আয়াত এবং হাদীছে জিবরীলের মধ্যে ইসলাম, ঈমান এবং ইহসানের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ফুটে উঠেছে। ইসলাম গ্রহণ করার সাথে সাথেই দ্বীনের সব কিছু সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা তাদের জন্য সম্ভব না হওয়ায় দ্বীনের প্রতি নির্মল ভালোবাসা এবং অটুট বিশ্বাসের শক্ত ভিত্তি রচিত হয়নি। তাই তারা আত্মসমর্পন করে মুসলিম হয়েছে মাত্র, প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করে মু'মিনের স্তরে তখনো উন্নিত হয়নি। সুতরাং জ্ঞানার্জন এবং শক্ত বিশ্বাসের ভিত রচিত না হওয়ার কারণে এ যুগেও একজন মুসলিম ব্যাক্তি সারাজীবন মুসলিমই রয়ে যায়, মু'মিনের স্তরে পৌঁছতে পারেনা।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে হিজরতের আগে যারা ঈমান এনেছিলেন তারা কোন লালসা, আবেগ বা কারো চাপে ঈমান আনেননি। বরং তারা প্রতিপক্ষের সমস্ত বিরোধিতা নিজ চোখে দেখেও শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য ঈমান গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ৯ম হিজরী সনে যখন ইসলাম একটি অজেয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল তখন দলে দলে যারা ইসলাম গ্রহণ করলেন তাদের অনেকেই শুরুর দিকে আবেগে, লোভে পড়ে, সম্মান রক্ষার উদ্দেশ্যে কিংবা ভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। এজন্যেই তাদেরকে মুসলিম বা আত্মসমর্পনকারী বলা হয়েছে। পরে তারা যখন জ্ঞানার্জন করে সমৃদ্ধ হলেন, পরিপক্ক ঈমানে বলিয়ান হলেন তখন তাদেরকে মু’মিন বলতে আর কোন বাধা রইল না।
নিম্নে ইসলাম, ঈমান ও ইহসানের তুলনামূলক পার্থক্য তুলে ধরা হলো।
#প্রাথমিক স্তর - ইসলাম
১. এই স্তরের অনুসারীর সংখ্যা অধিক।
২. এরা ইসলামের বিষয়গুলো আবছা আবছা জানে; গভীরভাবে নয়।
৩. বিশ্বাসটাও এদের হালকাই হয়, খুব একটা গভীরে শিকড় গাড়তে পারে না।
৪. অনেক সময় এরা না বুঝেই এবং দেখা-দেখি কিংবা ব্যক্তি ও সামাজিক প্রভাবেও 'আমাল করে থাকে।
৫. তাই এরা 'আমালে বেশি পিছুটান হয় এবং শাইত্বান এদেরকে সহজেই পারাজিত করতে পারে। ছোট-খাটো ওজর পেলেই এরা 'আমালের ক্ষেত্রে গড়িমসি শুরু করে।
#মধ্যম স্তর - ঈমান
১। এই স্তরের সদস্যদের সংখ্যা কিছুটা কম।
২। তারা যে 'আমালই করবে সে সম্পর্কে গভীরভাবে জানবে এবং বুঝবে।
৩। এবং এর লাভ, ক্ষতি ইত্যাদি মনে প্রাণে বিশ্বাস করে আস্থা ও দৃঢ়তার সাথে 'আমাল করবে।
৪। এরা ফরজ ও ওয়াজিব পর্যায়ের 'আমালের ক্ষেত্রে সজাগ থাকে। যেমন, হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এরা মাসজিদে গিয়ে ফরজ ছালাত আদায় করবে। বাসে ট্রেনেও এদের ফরজ সলাত কাজা হয়না। স্বামীর চাপেও পর্দা নষ্ট হয়ে দেয় না। ইত্যাদি
৫। এদের মধ্যে আল্লাহর ভয়, আশা ও ভালোবাসা কাজ করে।
#সর্বোচ্চ স্তর - ইহসান
১। এই স্তরের সদস্য সংখ্যা নিতান্ত কম।
২। এরা যে কোন 'আমাল চরম নিষ্ঠা (ইখলাস) ও পরম যত্নের সাথে আদায় করে, নিখুত, নির্ভুল ও সুন্দরভাবে আদায় করে।
৩। তারা 'আমালের ক্ষেত্রে ছোট ছোট ভুল-ভ্রান্তি থেকেও বেঁচে থাকে।
৪। ফরজ ওয়াজিব তো বটেই, ছোট ছোট মুস্তাহাব 'আমালগুলোও তারা এড়িয়ে চলে না।
৫। তারা নিজেদের উপর অপরকে এবং দুনিয়ার উপর আখিরাতকে সবসময় প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
৬। এদের মধ্যে আল্লাহর ভয়, আশা ও ভাল বাসা তিব্রভাবে জাগ্রত থাকে। এরা সারারাত বিছানায় ঘুমিয়ে কাটায় না, এদের অজুতে খুব কম পানি খরচ হয়, এরা অফিসের বসকে যেভাবে সালাম দেয়, ঠিক সেইভাবে গেটের দারওয়ানকেও সালাম দিয়ে থাকে। এরা রসিকতা করেও মিথ্যা বলবে না, অধিকার পেয়েও ঝগড়া করবে না, এদের আখলাক হবে সুবাসময়, এরা স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে মুখে লোকমা তুলে খাইয়ে দেয়
৭। পবিত্র কুরআন ও সুন্নায় এদেরকে সাবেরীন, শাকেরীন, যাকেরীন, মুখলেসীন, মুত্তাকীন, মুতাওয়াক্কিলীন, মুশফিক্বীন, সায়েমীন, সায়েহীন, তায়েবীন, কায়েমীন, ক্বানেত্বীন, মুন্ফিকীন, মুকসিত্বীন, মুনীবীন, মুহসিনীন ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে।
বিঃদ্রঃ কোথাও শুধু ইসলাম কিংবা শুধু ঈমান উল্লেখ করা হলে তখন সমগ্র দ্বীন ইসলাম বুঝতে হবে, স্তর নয়। যেমন: ইসলামে প্রবেশ করো.., ঈমান আনলে জান্নাতে যাওয়া যাবে, ইত্যাদি। এখানে পুরো দ্বীন উদ্দেশ্য আলোচ্য স্তরগুলো উদ্দেশ্য নয়।