Learn more
মানুষের জীবন শুরু হওয়ার সাথে সাথে যে দুইটি মৌলিক প্রয়োজন সবার আগে দরকার, তার একটি হল খাদ্য এবং অন্যটি হল বস্র বা পোশাক। একজন মানুষের সারাজীবনে এই দুইটি প্রয়োজনই সবচেয়ে বেশি জরুর। দেশ, সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি ও আর্থিক অবস্থান ভেদে এই দুইটি প্রয়োজনের ধরনের বৈচিত্র্যও সবচেয়ে বেশি। সারা পৃথিবীতে কত ধরনের খাবার আছে আর কত ধরনের পোশাক যে আছে তা হিসেব করাটা খুবই কঠিন।
খাবার ও পোশাকের ধরনের বৈচিত্র্য থাকলেও উভয়ের বৈচিত্রের মাঝে বড় একটা তফাৎ আছে। আর তা হলঃ খাবারের ধরনের বৈচিত্রের প্রয়োজনটা হল আভ্যন্তরীণ বিষয় যার জন্য অন্য মানুষকে ভাবনায় আনা দরকার পরে না। আমার খাবার আমার সাধ্য অনুযায়ী যা ইচ্ছে তাই আমি খেতে পারি। কিন্তু পোশাকের ধরনের বৈচিত্র্য হল বহিরাগত বিষয়। যেখানে নিজের থেকে অন্য মানুষকেই বেশি প্রাধান্য দিতে হয়। আমার পোশাক আমি পরলেও সমাজকে আগে প্রাধান্য দিতে হয় কারণ শরীর আমার, পোশাক আমার কিন্তু দেখবে সমাজ বা সমাজের অন্য মানুষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পোশাকটা পরাই হয় অন্যের থেকে নিজের শরীরকে আড়াল করার জন্য। পোশাক পরার হয় অন্যের চোখে নিজের শালীনতা রক্ষার জন্য।
পোশাকের ক্ষেত্রে কোন সাপেক্ষে কতাটা প্রাধান্য দিতে হয়, পোশাকের ধরণ কেমন হলে পোশাকের প্রয়োজন মেটানো হয় আর কতটা পোশাক একজন মানুষের শালীনতা রক্ষা করে সেই আপেক্ষিকতা নিয়ে কিছু ভাবনার প্রতিফলন।
মানুষ সাধারণত পোশাক পরে তিনটি কারনেঃ
১। প্রাকৃতিক কারনে - শীত, গরম বা পোকামাকড় ও জীবানু থেকে রক্ষা পেতে। যেমনঃ আমরা শীতের দিনে গরম হওয়ার জন্য আলেদা কাপড় পরি আবার গরমের দিনে ঠান্ডার জন্য হাল্কা পাতলা কাপড় পরি। বনে জংগলে খেতে খামারে পোকামাকড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভিন্ন ধরনের পোশাক পরতে হয়।
২। শরীরের সৌন্দর্য বিকশিত করতে।
যেমনঃ আমরা বিয়ে সাদি বা বিভিন্ন অনুষ্টানে, অফিসে বা মিটিং এ নতুন বা বিতিক্রম পোশাক পরি।
৩। আভ্রু ঢেকে শালীনতা রক্ষা করতেঃ
পৃথিবীতে অন্যান্য প্রানী থেকে মানুষের বড় একটা বাহ্যিক তফাৎ হল মানুষ পোশাক পরে আভ্রু ঢেকে শালীনতা রক্ষা করে। মানুষকে সভ্য জাতি বলার এইটা একটা কারন।
তিনটি কারণের মাঝে শেষের কারণটি পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে বেশি প্রাধান্য পায়। শালীনতা বলতে পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস এবং চলাফেরার ধরনকে বুঝালেও বর্তমান সময়ে পোশাকই বিভিন্ন সমাজে শালীনতার পার্থক্য হিসাবে ধরা হয়।
পোশাক পরার কারণ যাই হোক না কেন, যুগ যুগ ধরে পোশাক পরার ধরনটাই পোশাক পরার ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপুর্ন। পোশাক পরার ধরনের যেমন বৈচিত্র্য আছে, সেই সাথে সাথে ধরন নিয়ে আছে অনেক তর্ক বিতর্ক। আর পোশাকের এই ধরন কোথায় কেমন হবে তা নির্ভর করে পরিবার, সমাজ, দেশে ও ধর্মীয় সংস্কৃতির উপর। বাংলাদেশের মানুষ এক ধরনের পোশাক পরে আবার ইউরোপ আমেরিকার মানুষ আরেক ধরনের পোশাক পরে। ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্টান বা বৌদ্দ ধর্মের অনুসারীদের পোশাকের ধরনের মাঝেও রয়েছে অনেক বৈচিত্র্য।
পোশাকের ধরনটা কেমন হবে তা প্রথমত নির্ভর করে আপনার সামনে কে বা কারা আছে এবং তাদের সাথে আপনার সম্পর্ক কি, তার উপর। যেমন আপনি যখন একটা ঘরে একা থাকেন তখন যা ইচ্ছা তাই পরতে পারেন। এমন কি কোন পোশাক না পরেও থাকতে পারেন। এবার যখন কোন ঘরে শুধু স্বামী স্ত্রী থাকেন, তখন কিছুটা পোশাক আব্যশক হয়৷ আবার সন্তানের সামনে আরও কিছুটা পোশাক বেশি পরতে হয়। পরিবারের আরও কেউ থাকলে সেখানে আরেকটু বেশি পোশাক পরতে হয়। তারপর বাহিরে যখন যান, জনসমক্ষে আপনাকে, ঘরে যা পরতেন তার চেয়ে বেশি পোশাক পরতে হয়। ঘরের বাহিরে জনসমক্ষে পোশাক পরার ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই আপনার সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ চিন্তা করেই আপনাকে পোশাক পরিধান করতে হয় এবং করা উচিত।
দ্বিতীয়ত, পোশাকের ধরনের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ ভেদেও পোশাক পরার ভিন্নতা আছে কারণ পুরুষের তুলনায় একজন নারী অনেক বেশি সংবেদনশীল। তাই পুরুষের তুলনায় নারীর বেশি পোশাকের প্রয়োজন হয়।
শরীরের নির্দিষ্ট কিছু অংশ ঢেকে না রাখাকে অনৈতিক এবং অশালীন বলে বিবেচিত হয়। শালিনতা এর উদ্দেশ্য হল অপরকে শারীরিক বা যৌন আকর্ষণে উৎসাহিতকরণ থেকে বিরত থাকা। অনেক দেশে, নারীদের পুর্ণরুপে পোশাকে আবৃত রাখা হয়, যেন পুরুষেরা তাদের দ্বারা আকর্ষিত না হয়, এবং তাদের জন্য পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য পুরুষদের সাথে কথা বলাও নিষিদ্ধ। আবার, যেখানে বিকিনি পরার প্রচলন স্বাভাবিক সেখানে এক টুকরো কাপড় পরাও শালীন বলে বিবেচিত হয়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই লোকসম্মুখে নগ্নতাকে অভদ্র শরীর প্রদর্শন মনে করা হয়।
পোশাকের ধরনের ভিন্নতা নিয়ে এত বেশি তর্কবিতর্কের মাঝে বর্তমান যুগে আপনি কতখানি শরীর টেকে রাখলে আপনি শালিনতা রক্ষা করেছেন বা আপনি শালিন পোশাক পরেছেন বা কতটা পোশাক পরলে আপনাকে সমাজ ও সমাজের মানুষ ভালো বলবে সেটা সম্পুর্ন আপেক্ষিক বিষয়। কিন্তু শালিন পোশাক পরার জন্য সেই আপেক্ষিকতা বুঝতে হবে।
আর সেই আপেক্ষিকতা বুঝার জন্য একটু অংকের রেখাচিত্র বুঝার চেষ্টা করি। মনে করি, একটি সরল রেখাচিত্রে ০ এর ডানদিকে ১,২,৩, ৪,৫,৬,৭,৮… ইত্যাদি ধনাত্মক সংখ্যা হয় আর বামদিকে -১, -২, -৩….ইত্যাদি ঋণাত্মক সংখ্যা হয়। এখন -১, ০, ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮ এমন একটা রেখাচিত্র কল্পনা করি।
রেখাচিত্রের বামদিক থেকে ডানদিকে যত যাবেন সংখ্যার মান তত বাড়বে অর্থাৎ বামদিক থেকে ডানদিকে যাওয়া হল ভালোর দিকে যাওয়া। আবার ডানদিক থেকে বামদিকে যত যাবে ততই মান কমতে থাকবে অর্থাৎ ডানদিক থেকে বামদিকে যাওয়া হল খারাপের দিকে যাওয়া। এইটি সহজ একটা রেখাচিত্র যা যে কেউ সহজে বুঝতে পারার কথা।
এখন পোশাকের ক্ষেত্রে যদি একটি রেখাচিত্র তৈরি করি যেখানে সংখ্যার মানগুলো এমনঃ কোন পোশাক নাই (০), উপরে ও নিচে ছোট দুইটা পোশাক (১) , উপরে টিশার্ট ও নিচে আফপেন্ট (২), কামিস ও পায়জামা টাইপের পোশাক (৩), কামিস ও পায়জামা টাইপের পোশাকের সাথে ওরনা (৪), কামিস ও পায়জামা টাইপের পোশাকের সাথে চাদর ও হিজাব পরা (৫), মুখ খোলা রেখে বোরকা পরা (৬), বোরকা ও নেকাব পরা (৭), বোরকা ও নেকাব, হাত মোজা পা মোজা পরা (৮) ইত্যাদি।
এখন আগের রেখাচিত্রে পোশাকের এই মানগুলো যদি বসাই এবং লক্ষ্য করি, এই রেখাচিত্রে ৪ থেকে যত বামদিকে যাবো তত পোশাকের পরিমান কমতে থাকে। এখন রেখাচিত্রটির ২ নাম্বারটা যদি কোন নারী পরে যেখানে পোশাকের ধরন হলঃ উপরে টিশার্ট ও নিচে আফপেন্ট, তাহলে হয়তো কোন কোন সমাজের কিছু মানুষ এইটা সমর্থন করবে আর বাকি সবাই এইটাকে খারাপ বলবে কারন তাদের মতে সে শালিন পোশাক পরে নাই। এখন রেখাচিত্রটির ২ নাম্বারটার থেকে বামে গেলে কোন ভদ্র সমাজ এইটাকে সমর্থন করবে না। রেখাচিত্রটির ২ নাম্বারটার ডানদিকে গেলে মোটামুটি শালীন বলা যায় আর আরও এক পয়েন্ট ডানে গেলে আরেকটু বেশি শালীন বলা হয়। এভাবে যত ডানদিকে যাবে অর্থাৎ পোশাকের পরিমান যত বেশি হবে যত তার শালীনতা বৃদ্ধি পাবে।
এখন এই পোশাকের রেখাচিত্র থেকে আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন কোন ধরনের পোশাক আপনার সাপেক্ষে আপনার শালীনতা রক্ষা করবে। তবে আপনার জন্য যাই শালীন হোক না কেন বামদিক থেকে যত ডানদিক যাবেন সেই পোশাক বেশি শালীন এবং এইটা নিয়ে কারো আপত্তি না করে খুশি হওয়ার কথা। রেখাচিত্রের কোন দিকের পোশাকে আপনি নিজেকে ও আপনার পরিবারের অন্যকে শালীন বলে আপনার কাছে মনে হয় সেই মানদন্ডই পোশাকের ধরনের আপেক্ষিকতা।
সর্বশেষে দুইটি কথা,
প্রথমত কথা - যৌন আকর্ষণে উৎসাহিতকরণে পোশাকের কোনভাবেই দায়ী না এরকম কথা অনেকেই বলতে শুনি। আপনিও কি তাই মনে করেন? যদি মনে করে থাকেন, তাহলে আপনাকে আরেকটু ভাবতে হবে, আপেক্ষিকতা বুঝতে হবে। ধর্মীয় বিধিনিষেধ এর কথা বাদ দিলাম, আমরা সবাই কম বেশি সিনেমা দেখি। সিনেমায় যখন দেখি একজন নায়িকা খুব কম পোশাক পরে সিনেমা করে তখন একশ্রেণীর লোকেরা বলে এই সিনেমাটা হট বা সেক্সি, ভদ্র সমাজ বলে এই সিনেমাটি অশ্লীলন। অনেক সময় সেন্সরবোর্ড সেই সিনেমার পারমিশন দিতেও নারাজ এবং মাঝে মাঝে পারমিশন দেয় না । তাহলে কি আপনার মনে হয় না পোশাকের ধরন যৌন আকর্ষণের কিছু একটা বিষয়।
দ্বিতীয় কথা - নারীরাই শালীনতা ও অশালীনতা তর্কের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। আর এই তর্কের জন্য দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ কিংবা গুরুতর অপরাধ করেও অনেকেই শাস্তি পাচ্ছে না। যার ফলে দিন দিন এই ধরনের অপরাধ বেড়ে চলছে। তাই শুধু নারীর শালীনতায় পোশাকে দায়ী না করে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলাতে হবে। কোনো নারীর পোশাক পরার ধরনকে অশালীন না ভেবে নিজের দৃষ্টিকে নিয়ে ভাবা উচিত। দৃষ্টিরও আবার আপেক্ষিকতা আছে। পুরুষের এক ধরনের দৃষ্টি, নারীর আরেক ধরেনের দৃষ্টি। শালীনতা রক্ষায় পোশাকের ধরনের ক্ষেত্রে নারীর পোষাকের যেমন বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, তেমনি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে পুরুষকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পুরুষেরা দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে একটা বিষয় মনে করতে পারি - তা হলঃ আমরা কোন নারীর দিকে তাকানোর সময় এই কথা ভাবি যে, যদি এই নারীটি আমার মা, বোন বা মেয়ে হত আর অন্য কেউ এভাবে তাকালে আমি কি খুশি হতাম? যদি খুশি না হতে পারি তাহলে আমি কেন এভাবে তাকাবো?