Learn more
ভালোবাসার আপেক্ষিকতা
- ভালোবাসি শব্দ উচ্চারণের নয়।
সারা বিশ্বের সকল বয়সের মানুষের কাছে অনেক পরিচিত একটি শব্দ যে শব্দ ও তার ভাবার্থের উপর ভিত্তি করে প্রচুর গান, সিনেমা, ডকুমেন্টারি, কবিতা, এমনকি প্রচুর বই এবং নিবন্ধ তৈরি করা হয়েছে, হচ্ছে এবং আরও হবে। ইংরেজি চারটি অক্ষর দিয়ে শব্দটি হল LOVE যার বাংলা হল ভালোবাসা। বাংলায় ভালোবাসা শব্দটিও চারটি অক্ষর দিয়ে হয়।
প্রথমে, এই "ভালোবাসা" শব্দের অর্থ কী? স্পষ্টতই এটি সংজ্ঞায়িত করা খুব কঠিন কারণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন ধরণের ভালবাসা রয়েছে।
প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকরা ভালোবাসার পাঁচটি রূপ শনাক্ত করেছিলেন:
- স্টার্জ (Storge): পারিবারিক ভালোবাসা - প্রাকৃতিক স্নেহ, আপনি আপনার পরিবারের সাথে যে ভালবাসা ভাগ করেন।
- ফিলিয়া(Philia): বন্ধুত্বপূর্ণ ভালবাসা- বন্ধুদের জন্য আপনার যে ভালবাসা।
- ইরোস(Eros): রোমান্টিক ভালবাসা - যৌন এবং কামুক আকাঙ্ক্ষা ধরনের ভালবাসা (ইতিবাচক বা নেতিবাচক)
- জেনিয়া(Xenia): অতিথি ভালবাসা - আতিথেয়তা এবং
- আগাপে(Agape): ঐশ্বরিক ভালবাসা - এটি হল নিঃশর্ত ভালবাসা, কোন সীমাবদ্ধতা ছাড়াই, বা শর্ত ছাড়াই ভালবাসা।
ভালোবাসা একটি মানবিক অনুভূতি এবং আবেগকেন্দ্রিক একটি অভিজ্ঞতা। ভালোবাসা বিভিন্ন রকম হতে পারে। এমন কি কোনো কাজ কিংবা খাদ্যের প্রতিও।
কিন্তু আমি ভালোবাসার সংজ্ঞা বা তার বিভিন্ন রূপগুলি নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি না। এই নির্দিষ্ট শব্দ "ভালোবাসা" সম্পর্কে বিশেষ করে এর আপেক্ষিকতা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত আপনারদের সাথে ভাগাভাগি করতে চাই । মূলত আমি বলতে চাই যে ভালোবাসা এমন একটি শব্দ যা বলার জন্য নয়। যখন আমি কাউকে ভালবাসি, তখন সে আমার কার্যকলাপ বা তার প্রতি আমার গুরুত্ব দেখে সে নিজেই উপলব্ধি করতে পারে। "আমি তোমাকে ভালোবাসি" "আমি তোমাকে ভালোবাসি" এই বাক্যটি বার বার বলার দরকার নেই এবং যারা এইটি করে তাদের ভালোবাসায় সন্দেহ আছে ধারনা করা যায়।
কেন বার বার বলার দরকার নেই তার কিছু বাস্তব উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক।
১। সন্তানের প্রতি মা বাবার ভালবাসা
প্রথমেই আমি উল্লেখ করতে চাই, সবচেয়ে সত্য,সবচেয়ে সেরা, নিঃস্বার্থ ও বিশুদ্ধতম ভালোবাসা যা সন্তানের প্রতি পিতামাতার ভালোবাসা। প্রত্যেক বাবা-মা তাদের সন্তানকে খুব ভালোবাসে । এমনকি তারা তাদের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। কিন্তু তারা বারে বারে বলে না যে আমি আমার সন্তানকে ভালোবাসি। বিশেষ করে আমার বাবা-মা কখনোই আমাকে বলেনি আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু আমার বাবা-মা আমাকে পৃথিবীর অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসে। তারা আমার জন্য সবকিছুই করতে পারে। আমি মনে করে পৃথিবীতে প্রত্যক বাবা-মা ই তার সন্তানকে অনেক বেশি ভালোবাসে কিন্তু কখনো হয়তো বলা হয় না আমি আমার সন্তানকে ভালোবাসি। তারা তাদের ভালোবাসা প্রতি মুহ্ররতের তাদের কার্জকর্মে মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
২। প্রেমিক প্রেমিকার বা স্বামী স্ত্রীর ভালবাসা
দ্বিতীয়ত, আমরা সবচেয়ে বেশি পরিচিত এক ধরনের ভালোবাসা এবং সর্বাধিক মানুষ ভালোবাসা বলতে তাদের ভালোবাসাকেই বুঝায়। এই ধরনের ভালোবাসা হল প্রেমিক-প্রেমিকের মধ্যে ভালোবাসা অথবা স্বামী - স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা। এই ক্ষেত্রেও যদি কেউ সত্যিই অন্যকে ভালোবাসে তবে "আমি তোমাকে ভালোবাসি" বাক্যটি ব্যবহার করার দরকার পরে না। একে অপরের প্রতি তাদের দায়িত্ব থেকে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উপলব্ধি করা যেতে পারে। আর কেউ যদি একে অপরের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য না করে সারাদিন বলে "আমি তোমাকে ভালোবাসি", "আমি তোমাকে ভালোবাসি" তাহলে তা কখনোই সত্যিকারের ভালোভাসা হতে পারে না এবং আমার বিশ্বাস সে সম্পর্কও বেশিদিন টিকে না।
৩। ছাত্র শিক্ষকের ভালবাসা
পৃথিবীতে আরেকটি অন্যরকম ভালোবাসা হচ্ছে ছাত্র শিক্ষকের ভালবাসা। একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে ভালোবাসে বলেই ছাত্রকে সত্যের পথ দেখায়, নতুন ও আগামীর পথ দেখায়। আবার একজন ছাত্রও জীবনে যত উপরেই উঠোক না কেন, তার শিক্ষকে মন থেকে ভালোবাসে। তাদের এই ভালোবাসায়ও কখনো আমি আমার ছাত্র বা শিক্ষকে ভালোবাসি, এমন বাক্য বলার দরকার পরে না।
৪। ধর্মীয় ব্যক্তির প্রতি ভালবাসা
তৃতীয়ত, আমি যদি সবচেয়ে বেশি প্রশংসনীয় ব্যক্তি সম্পর্কে বলি, তাহলে এই পৃথিবীতে আমাদের নবী মোহাম্মদ (সঃ)-এর প্রতি ভালবাসার প্রথমেই আসে। এখন কেউ যদি প্রতিদিন হাজার বার বলে - হে নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ), আমি তোমাকে ভালোবাসি কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর কোন কথা না মানে, উনি যা উপদেশ দিয়েছেন তা না করো, যা নিষেধ করা হয়েছিল তা ত্যাগ না করো, তাহলে আপনি কিভাবে বলতে পারেন যে তিনি আসলে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কে ভালোবাসে। যারা কথা ও কাজে এক না ইসলামে এই ধরনের লোকদের বলা হয় মোনাফিক। অন্যদিকে, যখন কেউ যখন হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর আদেশ-উপদেশ এবং নিয়ম-কানুন সব সময় মেনে চলে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে, নিজের জীবনে উনার আদর্শ্য বাস্তবায়ন করে, তখন মুখে "আমি হযরত মোহাম্মদ (সঃ) ভালোবাসি" না বললেও সেই সত্যিকারে হযরত মোহাম্মদ (সঃ) ভালোবাসে।
৫। প্রিয় ব্যক্তির প্রতি ভালবাসা
একইভাবে, আমি আমাদের জাতীয় আদর্শ্য এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বলতে পারি। এখন আমরা মিটিং মিশিল, বক্তৃতা আর মিডিয়ায় সারাদিন যদি বলে বেড়াই আমাদের আদর্শ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভালোবাসি কিন্তু উনি যা করে গেছেন বা যা বলে গেছেন তা যদি না করি তাহলে সেটা বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা না, সেটা নিজের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য বলা।
৬। দেশকে ভালবাসা
পরিশেষে, সর্বাধিক সময়, আমরা দেখতে পাই যে, সারা দেশে রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর পোস্টার, ব্যানারে, মিটিং মিশিল, বক্তৃতা আর মিডিয়ায় সারাদিন বলতে থাকে তারা দেশের জন্য এই করেছে, সেই করছে এবং তারা দেশের জন্য, মানুষের জন্য অনেক কিছু করবে। তারাই প্রত্যকে নিজেরা নিজেরা দাবি ও প্রচার করে তারাই দেশকে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু সর্বাধিক সময় ও সবচেয়ে বেশি তারাই দেশের নিয়ম বঙ্গ করে। দেশের ভিতরে-বাহিরে লক্ষ লক্ষ মানুষ খেতে-খামারে, পথে-ঘাটে, কারখানায় সারাদিন কাজ করে নিজের সংসার চালিয়ে সমাজের ভালো ভালো কাজে অংশগ্রহণ করছে। তারা কখনো বলে না আমি আমার দেশকে ভালোবাসি। তাহলে তারা কি দেশকে ভালোবাসে না? তারা কি দেশপ্রেমিক না? প্রকৃতপক্ষে তারাই দেশকে সত্যিকারের ভালোবাসে। মা বাবা যেমন সন্তানের জন্য সারা জীবন উৎসর্গ করেও তাদের কাছে কিছু চায় না বা বলে না আমি তোমাকে ভালোবাসি, তেমনি একটি দেশের ঐ সমস্ত মানুষই দেশকে ভালোবাসি না বললেও প্রকৃতপক্ষে তারাই দেশকে ভালোবাসে।
ভালবাসার রূপ বা ধরন যা ই হোক না কেন, সেটা কোণ ব্যক্তি বা বস্তু হোক আর সমাজ বা দেশ হোক, ভালবাসা উচ্চারণ করে বলার জন্য না, ভালবাসা হয় ভালবাসার মানুষ বা দেশের প্রতি তার কাজে-কর্মে, ভালোবাসা হয় তার দায়িত্ব ও কর্তব্যে। আর যারা মুখে মুখে বেশি বেশি ভালোবাসি ভালোবাসি বলে তাদের ভালোবাসা হল লোক দেখানো, তাদের ভালোবাসা হল নিজেদের স্বার্থের জন্য।