Learn more
দ্বন্দ্ব-কলহ, ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, গোলমাল-হানাহানি, সংঘাত-সংঘর্ষ, সহিংসতা-উগ্রতা কেন হয়? আমার ছোট বেলা থেকে মনে মাঝে একটা প্রশ্ন ছিল - মানুষ কেন ঝগড়া করে?
আমাদের বংশ বা গোষ্ঠীর সাথে অন্য গোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য তেমন ঝগড়া আমার মনে পরে না আর বাবা চাচারা তেমন ঝগড়া করে না তবে আমাদের মা চাচিদের মাঝে ছোট্ট কাল থেকেই ছোট খাটো কিছু ঝগড়া দেখেছি। এখন বাড়ি থাকি না তাই এখনো ঝগড়া হয় কিনা তা জানতে পারি না। তবে বাড়ি যাওয়ার পর মা চাচিদের সাথে কথা বললে বুঝা যায় যে ছোট্ট বেলা থেকে যে ঝগড়া দেখে আসছি তার ফল এখনো বিদ্যামান। তার মানি হল তারা যে ঝগড়া করেছিলো তা পারফেক্ট কন্টিনিউস ছিলো মনে হয়। ঝগড়ার নিয়মই এইটা ঝগড়া লাগার পর এইটা যদি ধরে রাখি তাহলে সেটা দিন দিন আরো বাড়ে। মা চাচিরা মোটামুটি ধর্ম পরায়ন, ধর্মের আদেশ নির্দেশ মেনে চলার চেস্টা করে। তবে তাদের এই ধর্ম কর্ম পালন কে আমার কাছে রাজনৈতিক দলে ধর্ম কর্ম পালনের বিপরীত মনে হয়। রাজনৈতিক দল তাদের স্বার্থ না থাকলে কখনই ধর্মকে নিয়ে আসে না আর আমার মা চাচিরা তাদের স্বার্থ জায়গায় ধর্মকে আনতে চায় না। আমি প্রায় আমার মা চাচিদের বললতাম ঝগড়া লাগার পর কোন মুসলমান অন্য মুসলমানের সাথে তিন দিনের অধিক কথা না বলে থাকা জায়েয নয়। তখন তারা বলত রাখ তোদের জায়েয-নায়েজ। তাদের ঐই সময়ে বুঝালে কোন কাজেই আসতো না। অনেকদিন চলে যেত সেই ঝগড়ার রেশ। আর এই ছোট্ট ছোট্ট দ্বন্দ্ব-কলহ, ঝগড়া-বিবাদ কখনো কখনো বড় বড় দাঙ্গা-হাঙ্গামা, গোলমাল-হানাহানি, সংঘাত-সংঘর্ষ, সহিংসতা-উগ্রতা যা থেকে তৈরি হয় চিরদিনের হিংসা-বিদ্বেষ। আর এইটা হতে পারে ভাইয়ে ভাইয়ে, পরিবারের পরিবারে, হতে পারে সমাজে সমাজে, পাড়ায় পাড়ায়, গোষ্ঠী গোষ্ঠী, হতে পারে দলে দলে, দেশে দেশে আবার হতে পারে ধর্মে ধর্মে। এগুলো বাস্তবে আমরা দেখতে পাই এবং আমি যেমন জানি সবাই জানে। মা চাচি মাঝে যেমন ঝগড়া হয় তেমন বউ শাশুড়ী মাঝে ঝগড়া হয়, ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া হয় আবার দলে দলে ঝগড়া হয়। ঝগড়া যাদের মাঝেই হোক না কেন কেউ কি জানেন এই ঝগড়া লাগার মূল কারনটা কি? অনেকেই বলবেন স্বার্থ হল ঝগড়া লাগার মূল কারন কিন্তু ঝগড়া লাগার মূল স্বার্থ না, অন্য কিছু আর সেটাই আজ আলোচনার মূল বিষয়।
১.
আমার কাছে এই ঝগড়া লাগার মূল কারন হল বুঝের আপেক্ষিকতা। অর্থাৎ অন্যকে বুঝার বুঝ না থাকা। আমার মনে হয় বুঝতে পারলেন না, তাই না? কি আবোল তাবোল বলতে চাইছি, আসেন একটু বুঝার চেষ্টা করি।
আমার দুইটি ছেলে যখন এক সাথে থাকে বিশেষ করে ছুটির দিনে সারাক্ষন এক সাথে খেলাধুলা করে আর সারাক্ষনই ঝগড়া ঝাটি, মারামারি করতেই থাকে। একটু পরে আবার দুইজন মিলেমিশে আবার খেলাধুলা করে। তাহলে নিজেদের মাঝে ঝগড়া ঝাটি করলো কেন? আমরা ত বড়রা বাসায় থাকলে এরকম ঝগড়া ঝাটি করি না। আর করলেও সাধারনত ছোটদের সাথে করি না। কারন আমরা বুঝি যে তারা ছোট, তারা আমাদের মত বুঝে না।
আবার কোন রিক্সার ড্রাইভার বা বাসের হেল্পার থেকে ভালো বুঝে এমন কেউ ওদের সাথে তর্ক করে না কারন তারা বুঝে যে রিক্সার ড্রাইভার বা বাসের হেল্পারের বুঝ আর আমার বুঝ সমান না। সমান হলে সে এই জায়গায় থাকত না, সে থাকত আমার অবস্থানে বা আমার অবস্থানের উপরে বা আসে পাসে। আর যাদের বুঝ রিক্সার ড্রাইভার বা বাসের হেল্পার এর সমান বা কম তারাই ওদের সাথে তর্ক করে।
আরও সহজ করে বললে আপনি কি রাস্তার কোন উলঙ্গ পাগলের সাথে তর্ক করবেন? নিসন্দেহে করবেন না কারন পাগলের বুঝ আর আপনার বুঝ এক না। ঠিক একই বিষয় ঘটে যখন আমরা সুস্থ দু’জন বা দুটি দলের মাঝে ঝগড়া হয় তখন আমরা বুঝতে পারি না যে অন্য জনের বুঝ আর আমার বুঝ এক না। আর এই না বুঝার জন্যই পৃথিবীতে যত ঝগড়া ঝাটির সৃষ্টি হয়।
স্বার্থ ঝগড়ার কারন হিসেবে আমরা মনে করি বা মনে হয় কিন্তু কোন ঝগড়ার পরে কারো স্বার্থ হাসিল হয়েছে এমন কিছু দেখা যায় না বরং স্বার্থটা আসেই না বুঝার ফলে। আবার স্বার্থ হাসিল হলে অনেক ক্ষেত্রে তা সে ভোগ করে যেতে পারে না। তাই স্বার্থ ঝগড়ার কারন হলেও ঝগড়া ঝাটির মূল কারন নয়। ঝগড়া ঝাটির মূল কারণ হল অন্যকে বুঝার বুঝ না থাকা।
২.
আমরা দেখি যে প্রত্যেক ঝগড়ার পরে একটা ফলাফল পাওয়া যায় হয় তা হল বিভক্তি। আমরা যে অবস্থান বা পরিস্থিতিতে ঝগড়া করি না কেন ঝগড়ার চুড়ান্ত ফল আপনাকে আমাকে ভাগ করে দিবে। বউ শাশুড়ীর ঝগড়ার ফলে বাব-মা আর ছেলে আলেদা হয়, ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়ার ফলে ভাই ভাই আলেদা হয়, সমাজের কারো সাথে ঝগড়ার ফলে মসজিদ আলেদা হয়, জাতীয় দল বা মতবাদের মাঝে ঝগড়ার ফলে নতুন নতুন দল তৈরি হয়, এক ধর্মের সাথে অন্য ধর্মের ঝগড়ার ফলে দেশে সম্পৃতি বিভক্তি হয়, একই ধর্মের ভিতর ভিন্ন মতবাদীদের মাঝে ঝগড়ার ফলে ভিন্ন ফেরকার বা তরিকার সৃষ্টি হয়। এভাবে পৃথিবীতে যত ঝগড়া হয় তার একটা ফলই দেখতে পাই তা হল ভাংগন বা বিভিক্তি।
৩.
এখন ঝগড়ার কারন ও ফল যদি বুঝের আপেক্ষিকতা হয় তাহলে তার সমাধান কি? এর সমাধান হল আপেক্ষিকতা বুঝা এবং সেই অনু্যায়ী কথা বলা বা কাজ করা। আর সেটা করার জন্য আমাদের চিন্তাটা পরিবর্তন করতে হবে। পৃথিবীতে কেউই খারাপ মানুষ না আবার কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে না। না বুঝা বা না জানার ফলে সবাই ভুল করে। সেটা আসলে ভুল বললে ভুল হবে আসলে মানুষ ভুলও করে না। সে যা জানে, যতটুকু বুঝে সেই অনুযায়ী কাজ করে বা কথা বলে।
ঝগড়ার পিছনে কমপক্ষে দুইটি পার্শ্ব থাকে। এখন এক পক্ষ যদি আপেক্ষিকতা বুঝে সেই অনুযায়ী কথা বলে বা কাজ করে তবে ঝগড়া ৬০% কমে যাবে আর দুই পক্ষই যদি বুঝে তাহলে আর ঝগড়াই হবে না। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ও মধুর সম্পর্ক হল স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। এখন কোন কাজ করা বা কথা বলার সময় যদি আপনে মনে করেন আমিই সঠিক এবং অন্যজন(স্বামী/স্ত্রী) বলে, না তুমি সঠিক না, আমি সঠিক তাহলেই ঝগড়া শুরু আর কেউ যদি বলে ঠিক আছে তুমিই সঠিক। এবার বল ত তুমি কিভাবে কাজটি করতে চাইছো বা তুমি যে সঠিক তা একটু আমাকে ব্যখ্যা করে বুঝাও । আপেক্ষিকতা বুঝা অর্থ হল কেউ ভুল করে না। সে যা জানে সেই অনুযায়ী কথা বলে। যখন একজন কিভাবে সঠিক তা বলতে যাবে তখন তার না জানার বিষয়টা সে নিজেই বুঝতে পারবে এবং তখন আর তর্ক করতে যাবে না। এভাবে বউ শাশুড়ীর মাঝে যখন তর্ক হয়, তখন যদি শাশুড়ী বুঝার চেস্টা করে, বউ ত আমার মেয়ে মত, এখনো অনেক জানার বাকি আছে এবং সেই অনুযায়ী বউয়ের সাথে কথা বলে আর বউও যদি মনে করে আমার শাশুড়ী ত আমার মায়ের যুগের মানুষ, বর্তমান সময় সম্পর্কে উনি ততটা জানে না, তাই এমন বলতেই পারে আবার বউ যদি মনে করে আমিও ত একদিন শাশুড়ী হবো। বউ শাশুড়ী দুইজনই যদি অন্যের জায়গা থেকে চিন্তা করে তাহলে আমার বিশ্বাস আর ঝগড়া হবে না।
আর এভাবে আপেক্ষিকতার বুঝ আমাদের মাঝে প্রত্যেকের মাঝে থাকলে ভাইয়ে ভাইয়ে, সমাজে সমাজে, ধর্মে ধর্মে বা দেশে দেশে কোন ঝগড়াই থাকবে না। এছাড়া আর যত কিছুই করেন যেমন সমাজ থেকে কাউকে বিতারিত করা, ব্যাক্তি বা দলকে নিশিধ করা, হাজার হাজার আইন করা তা কোন কিছুই কাজে আসে না। এর কারন হল কেউ যখন অপরাধি হয় সে যদি নিজে যতক্ষন না বুঝবে যে সে অপরাধি, সে যা করছে তা অন্যায় ততক্ষন সে ঐ কাজ ছাড়বে না। আপনি তাকে আইন করে জেলে দিলেন সে বলবে আমাকে অন্যায়ভাবে জেলে দিছে এবং জেল থেকে মুক্তির পর একটা প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবনতা থাকবেই।
চুড়ান্ত কথা হল, আপেক্ষিকতা না বুঝলে অর্থাৎ অন্যকে না বুঝে নিজের মত করে কথা বা কাজ করলে ঝগড়া থাকবেই।
আর তখন
পান থেকে চুন,
খসলেই খুন।
ঝগড়া চলছে চলবেই।