Learn more
প্রথম গল্প- জ্ঞানের সুত্র:
"তুমি এখন থেকে 'ম' এর জায়গায় 'ব' বসিয়ে কথা বলবে" বাসার কাজের লোকের ভাষা শুদ্ধ করতে এই সুত্র শিখিয়ে দিল তার মালিক কারন কাজের লোক সাধারণত তার আঞ্চলিকতায় যামো, খামো আনমো, বলমো ইত্যাদি বলত। সুত্র প্রয়োগ করলে হবে যাবো, খাবো, আনবো, বলবো ইত্যাদি। সেইভাবে চলছে। একদিন লোকটি বাসার ভিতর গিয়ে বলছে, স্যার আপনার বাবা এসেছে। স্যার বলছে, কি বলছো আমার বাবা ত ৫ বছর আগেই মারা গেছে। তারপরও বলছে, না স্যার আপনার বাবা এসেছে, আপনে দেখে যান। দেখার পর বলে, উনি ত আমার মামা। তখন কাজের লোক বলছে স্যার আপনি না আমাকে বলছেন -"তুমি 'ম' এর জায়গায় 'ব' বসিয়ে কথা বলবে", তাহলে মামা ত বাবা ই হয়।
এই গল্পের, মালিক তার জ্ঞান দিয়ে সুত্র তৈরি করছে আর কাজের লোকও জ্ঞান দিয়ে তা প্রয়োগ করেছে। সুত্র ও প্রয়োগ সবই ঠিক আছে। কিন্তু প্রাসঙ্গিকতা ঠিক ছিল না। জ্ঞান হল কিছু বিষয়ে বাদা ধরা কিছু তত্ত্ব । জ্ঞান হল আমাদের জড়ো করা কিছু অনুমান। জ্ঞান হল সুত্রে মত, যেখানে কিছু পালটে গেলে যেইটা যেমন, সেইটা তেমন থাকে না। এই জ্ঞান আমাদের আত্নবিশ্বাসী করে তুলে। যার জ্ঞান যত বেশি সে তত আত্নবিশ্বাসী। কিন্তু সব সময় এই জ্ঞানের আত্নবিশ্বাস দিয়ে জীবন চলে না। জ্ঞান চলতে পারে, যখন দুনিয়ায় পার্থিব কোন জিনিস(ঘরবাড়ি, রাস্তঘাট, ব্রিজ, জাহাজ ইত্যাদি) তৈরি করার ক্ষেত্রে।
দ্বিতীয় গল্প- প্রাসঙ্গিকতা:
ছোটবেলা মা-বাবা থেকে শুনা আরেকটা গল্প এমন: এক রাজ দরবারে ভরা মজলিসে সভা চলছিলো । সভায় আলোচনা চলছে। এমন সময়, রাজার বাড়ির চাকর, বাড়ির ভিতর থেকে জোরে জোরে বলছে, রাজা মশাই, রাজা মশাই, রানি আজ কাঞ্জির জাও রান্না করছে। রানি আপনাকে খেতে ডাকছে। (কিছু দিন কম রান্না করা চাউল ভিজিয়ে রেখে তা দিয়ে জাও পাক করলে তাকে গ্রামের ভাষায় কাঞ্জির জাও বলে যা খেতে একটু টক লাগে। আর এই খাবারটি ছিল একটু নিন্মমানের এবং গরিব লোকের খাবার।) রাজ সভা চলাকালীন সবার সামনে কাঞ্জির জাও এর কথা বলাতে রাজা একটু লজ্জা পেল। আর চাকরকে থমক দিয়ে বলল, বাড়ি ভিতরে কিছু হলে আমার কাছে এসে কানে কানে বলবে। তারপর একদিন রানির পাক ঘরে আগুন লাগছে। এবার সেই চাকর বাড়ি থেকে বের হয়ে রাজ দরবার পেরিয়ে রাজার কাছে গিয়ে কানে কানে বলছে, রাজা মশাই, রাজা মশাই, রানির পাক ঘরে আগুন লাগছে। রাজা তখন তাকে থমক দিয়ে বলছে, ঘরে আগুন লাগছে, আর তুই আমার কানের কাছে এভাবে বলছ? বাড়ির ভিতর থেকে চিল্লায়া বলা যেত না? দিল কড়া থমক।
এখানে বুঝার বিষয় হল প্রাসঙ্গিকতা, বুঝার বিষয় হল বিষয়ের আপেক্ষিকতা। কোন বিষয়ের উপর কখন বেশি জোর দিতে হবে, কোন বিষয়ের উপর কম জোর দিতে হবে, তা আগে বুঝতে হবে। গল্পে চাকর রাজার কাছে দুই বারই থমক খাইলো কারন অবস্থার আপেক্ষিকতা না বুঝার কারণে।
এভাবেই জীবনে আমরা অর্জিত জ্ঞানের আত্নবিশ্বাসে আমরা সবাই প্রায় বলি - আমিই ঠিক, আমিই ঠিক। আত্মবিশ্বাসী হওয়া ভালো তবে বেশি আত্নবিশ্বাসী হওয়া, অন্ধ হওয়ার ই সামিল। আত্নবিশ্বাস থাকলে মানুষকে মুগ্ধ করা যায় কিন্তু জীবননের জন্য দরকার আপেক্ষিকতা বুঝা, প্রাসঙ্গিক হওয়া। গবেষনায় দেখা যায়, যারা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী তারা বিভিন্ন বিষয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন। আর এতে প্রায়ই তারা বিভিন্ন অবস্থার সঙ্গে তাদের মস্তিষ্ককে মানিয়ে নিতে পারেন না। ফলে তাদের চিন্তাভাবনাতেও সে বিষয়টি প্রতিফলিত হয় এবং তা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
মুল কথা- বেশি আত্নবিশ্বাসী না প্রাসঙ্গিক:
আত্নবিশ্বাস দীর্ঘস্থায়ী হয় না, আত্নবিশ্বাস নিয়ে আজ যেটাকে 'এইটাই সেইটা' বলছেন, ৩-৪ বছর পর অনেক ক্ষেত্রেই 'এইটাই সেইটা' থাকে না। আমরা যতই পরিকল্পনা করি না কেন, কেউ ১০০℅ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না যে তার সব কিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হবে। আগামীকাল কি হবে, আমরা কেউই জানি না। তার বড় উদাহরণ হল কোভিট ১৯। পৃথিবীর জুড়ে ২০২০ নিয়ে অনেকেই অনেক পরিকল্পনা করছে। কিন্তু অধিকাংশেরই পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবে হয় নাই কোভিট ১৯ কারণে।
অনেক সময়, আমি যা করি, তাতে আমিই ঠিক বলে ভাবটা পরিস্থিতিতে অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে। বর্তমানে কম্পিউটার সাইন্সে সবচেয়ে বেশি যুক্তি দিয়ে কাজ হয়। এখন আমি ১০ বছর আগ থেকে
কম্পিউটার সাইন্সের একটা বিষয়(প্রসেস বা ফাংশন বা সুলিয়শন) নিয়ে কাজ করে আসছি এবং বলছি এইটা এইভাবেই হয় এবং এইটাই ঠিক। কিন্তু ১০ বছর ধরে প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার ফলে সেই বিষয়টা অন্যভাবে হতে পারে এবং পরিবর্তন হয়। তখন যদি আমি বলি, না, আমিই ঠিক, তাহলে সেটাই অপ্রাসঙ্গিক।
একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটা হল, আপনি প্রাসঙ্গিকতা বুঝেন। যে পরিস্থিতিতে আছেন, সেই পরিস্থিতিতে আপনি প্রাসঙ্গিক। আর সেক্ষেত্রে সবসময় আপনি ঠিক নাও হতে পারেন। আমিই ঠিক, আমিই ঠিক, আমিই ঠিক সেটাই আত্নবিশ্বাস, তবে আপনার ঠিক হওয়ার কেউ পরোওয়া করে না। যেই বোকারা আমিই ঠিক, আমিই ঠিক ভাবেন, তাদের ধারে কাছে কেউ থাকতে চায় না। সাধারণত তাদের সবাই পছন্দ করে না।
জীবনে যেই পরিস্থিতিতে আছেন, সেই পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক হওয়াটা আত্নবিশ্বাসী হওয়া থেকে বেশি গুরুত্বপুর্ন । আর প্রাসঙ্গিক হতে হলে অবস্থার আপেক্ষিকতা বুঝতে হবে। দুইটি গল্পেই অবস্থার আপেক্ষিকতা বুঝের অভাব ছিলো। নিজের জীবনে প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আসতে হলে আত্নবিশ্বাসের জলাঞ্জলি দিয়ে আপেক্ষিকতা বুঝে চলতে হবে।