Learn more
স্মৃতিচারনে নাজনীন সুলতানা ম্যাডাম, ম্যানেজিং ডিরেক্টর(১৯৯৭-২০২২), গ্রামীণ কমিউনিকেশন্স।
গতকাল(২৯-১২-২০২২) ছিলো আমাদের গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, সবার প্রিয় আপা নাজনীন সুলতানা ম্যাডামের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসাবে শেষ কর্মদিবস।
আমি ২০১৩ সালে গ্রামীণ সল্যুশনসে জয়েন করি। আমাকে নেওয়া হয়েছে মুলত প্রোফেসর মোহাম্মদ ইউনুস স্যারের একটা প্রোজেক্টে কাজ করার জন্য। জয়েন করার এক মাস পর্যন্ত এতটুকু জানতাম। জুলাইয়ে প্রোগ্রাম, তিন মাসের একটা ডেইডলাইন ছিলো। তাই কাজের চাপ ছিলো। হঠাৎ একদিন আমার পিছনে এক মহিলা। আমারে জিগেস করছে আমাদের কাজের কি অবস্থা? আমি চেয়ার থেকে ওঠে দাড়ালাম, ম্যাডাম বললেন আপনি বসেন, কাজ করেন আমি আসছি এমনি দেখা করতে, খোজ খবর নিতে। তখনো চিনতাম না নাজনীন ম্যাডাম কে, গ্রামীণ কমিউনিকেশন্স সম্পর্কেও জানতাম না।
ম্যাডামের পিছনে ছিলো গ্রামীণ সল্যুশনসের এডমিনের রানা ভাই। উনি তখন পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, উনি গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আর এই প্রোজেক্টটা উনারা আমাদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। প্রোজেক্টটি ছিলো গ্রামীণ ব্যাংকের নেক্সট ভারশন স্যোসাল বিসিনেস নিয়ে একটা ওয়েব পোর্টাল যেখানে স্যোসাল বিসিনেস নিয়ে বিশ্বে যেখানে যাইহোক সব এক প্লাটফর্মে রাখা।
তার কিছু দিন পর ১৬ তলায় প্রোফেসর মোহাম্মদ ইউনুস স্যারের সাথে প্রোজেক্টের ডেমোস্ট্রেশন হয়। ডেমোস্ট্রেশনের পর লিফটে নামার সময় নাজনীন ম্যাডাম আমাকে উদ্দেশ্য করে একটা কথা বলেছিলেন যা নিয়ে প্রায় আমি ভাবি,ছোট ছোট থেকে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখি। উনি বলেছেন,
"গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য প্রথম এমএফআই সফটওয়্যার আমরা এমন ছোট করে শুরু করেছিলাম যা আজ দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহার হচ্ছে। স্যোসাল বিসিনেস নিয়ে এই পোর্টালও একদিন এমন বড় হবে।"
সেই থেকে বড় কিছু মাথায় রেখে ছোট করে শুরু করার একটা অনুশীলন করি।
এক বছর পর আমার কাজে সন্তুষ্ট ও প্রোজেক্টের প্রয়োজনে ম্যাডাম আমাকে গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সে বসে কাজ করতে বলে, তার ৬ মাস পর গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সের পেরুলে চলে আসতে বলে। তখন পরে গেলাম চিন্তায় কারণ আগে গ্রামীণ কমিউনিকেশন্স আইটি কোম্পানি ছিলো শুধু মাত্র গ্রামীণ ব্যাংকের সফটওয়্যার ও সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। অন্যান্য সফটওয়্যার ফার্মের মত সফটওয়্যার কোম্পানি ছিলো না। শুধু ভালো একটা প্রোজেক্ট ও নাজনীন ম্যাডাম এর মত ভালো একজন লিডারের সাথে সরাসরি কাজ করবো বলেই রাজি হলাম। তাও ছিল কন্ট্রাকচুয়াল। ভাবছিলাম কিছু দিন পরে চলে যাবো। কিন্তু আর যাওয়া হলো না। সেই থেকে এই পর্যন্ত ম্যাডামের সাথে সরাসরি কাজ করে আসছি। গতকাল ছিল উনার সাথে কাজের শেষদিন।
গতকাল উনার ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদ থেকে বিদায় নেওয়া দিনে অনেকেই অনেক কথা বলছেন। উনার ভালো ভালো দিক নিয়ে সবাই যার যার স্মৃতিচারন করেছেন। সবার স্মৃতিচারন থেকে রাজিব ভাই একটা কথা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আর সেটা হল -
"ম্যাডাম যেকোন কাজ করার আগে সবার থেকে মতামত নিতেন তারপর সিদ্ধান্ত দিতেন।"
সবার থেকে মতামত নিয়ে কাজের সিদ্ধান্ত নেওয়া কেন একটা বড় গুন তা নিয়ে রাজিব ভাই ব্যাখ্যাও দিলেন- মতামত নেওয়াতে সবাই গর্ববোধ করে এইভেবে যে আমার মত ছোট মানুষ থেকে আমাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মতামত নিছে। আসলেই মনস্তাত্ত্বিকভাবে মানুষ তাই আশা করে আর এতে কাজও ভালো হয়। এতে প্রত্যেকে কাজের ধরন ও গভীরতা সম্পর্কে চিন্তা করতে পারে আর সবাই এক হয়ে কাজ করতে উৎসাহিত হয়।
ম্যাডামের সাথে আমার অনেক স্মৃতি আছে, অনেক দেশে ঘুরার সুয়োগও হয়েছে। মানুষ হিসাবে উনি কেমন সেটা এখানে লেখে বুঝানো যাবে না। গ্রামীণ বড় একটা পরিবার। অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান এক বিল্ডিং এ। সব প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সহ অনেক সিনিয়র ভাইদের সাথে আমার মোটামুটি পরিচয় আছে। আমরা অনেক সময় বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলি। যখনি আমাদের ম্যাডাম এর প্রসঙ্গ আসত, সবাই একটা কথাই বলত- আরে, আপনার ম্যাডাম ত ভালো মানুষ। আমি মনে করি একটা মানুষের জীবনে এর চেয়ে আর বড় কোন সফলতা থাকতে পারে না।
সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুবাদে সম্মানিত নাজনীন ম্যাডামের সাথে আমি সরাসরি কাজ করতাম। উনার খারাপ দিক বা মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার কোন ঘটনা আমার সাথে হয় নাই বা হইলেও আপেক্ষিকতা বুঝার ধরন আমি সেটাকে খারাপ হিসাবে নেই নাই। কাজের ক্ষেত্রে একটা কথা, উনি ও উনারা যেই কাজ শুরু করতো তার কোন সুনির্দিষ্ট প্লান থাকতো না। পুরোপুরি এজাইল মোডে কাজ হত। এতে করে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের সিদ্ধান্ত নিতে ও পরবর্তীতে মেইনটেইন করতে অনেক সময় সম্যসা হত কারণ বিজনেস লজিকে অনেক পরিবর্তন হয়ে যেত । সম্প্রতিও গ্রামীণ ডিজিটাল হেলথ নিয়ে এই রকম একটা আনপ্লান্ট কাজ করতেছি। উনার সাথে এই ধরনের কাজ নিয়ে যখনি কথা বলি, উনি একটা কথা বলেন - আমরা এভাবেই কাজ করি।
আসলেই গ্রামীণ এভাবেই কাজ করে। সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে। বাংলাদেশে যখন কম্পিউটার ও আইসিটি নিয়ে শহরে শিক্ষিত মানুষেরই তেমন ধারণা ছিলো না, সেই সময়ে মোবাইল, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে দিতে, গ্রামের মানুষ কিভাবে আইসিটির সেবা দিতে পারে তা নিয়ে গ্রামীণের হয়ে এই ম্যাডাম কাজ করেছেন। যা হয়তো তেমন প্লান প্রোগ্রাম করে করা সেই সময়ের জন্য ততটা সহজ ছিলো না। ম্যাডামের জীবনের বাস্তব অনেক অভিজ্ঞতা ও সফলতা আছে বলেই তিনি অনেক গর্ব করে বলেন -
আমরা এভাবেই কাজ করি। এইটাই আমাদের স্টাইল।
আর এভাবে কাজ করতে করতে নাজনীন ম্যাডামের নেতৃত্বে তৈরি হয় গ্রামীণ ব্যাংকের সফটওয়্যার, মাইক্রোফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার, স্যোসাল বিসিনেস পিডিয়া -আ অয়েব পোর্টাল, কনফারেন্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, নবীন উদ্যোগতা ম্যানেজমেন্ট ও মনিটরিং সিস্টেম, জিকে হেলথ ইআরপি সহ আরও অনেক বড় বড় সিস্টেম যেগুলো এখন দেশে-বিদেশে চলছে। গ্রামীণ ব্যাংক সহ দেশে-বিদেশে ২০০ টিরও বেশি সংস্থায় এখন MFI সফটওয়্যারটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
এভাবে কাজ করতে করতে ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে আইটি ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা থাকার কারণে তিনি অ্যাকসেঞ্চার বাংলাদেশসহ বিভিন্ন আইটি কোম্পানির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দরিদ্রদের জন্য সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং উন্নয়নের জন্য আইসিটি নিয়ে কাজ করে এরকম অনেক এনজিওগুলির কার্যনির্বাহী সদস্য হিসাবে কাজ করেন। অনেক সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গঠনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন তার দীর্ঘ কর্মজীবনে।
নাজনীন সুলতানা 1997 সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে গ্রামীণ কমিউনিকেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে বিএস এবং এমএস সম্পন্ন করার পর, তিনি গ্রামীণ ব্যাংকে তার কর্মজীবন শুরু করেন এবং ব্যাংকের আইসিটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিমধ্যে, তিনি থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে ডিপ্লোমা অর্জন করেছেন।
সবশেষে ম্যাডামের নতুন অধ্যায়ে নতুনভাবে উপভোগ করার শুভকামনা এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য দোয়া।