একজন মানুষ যেই পেশায় আছে, সেই পেশাকেই সেরা মনে করবে, সেটা স্বাভাবিক বিষয় এবং তাই করা উচিত কারন এতে তার নিজের পেশার প্রতি নিজের আত্ববিশ্বাস বাড়ায় আর কাজের প্রতি মনযোগ সৃস্টি করে। তাই বলে অন্য পেশাকে কখনো ছোট করে দেখা যাবে না। এইটাই আমি মনে করি কারণ সমাজে সব পেশার লোকেরই দরকার আছে।
কিন্তু অন্যান্য পেশা থেকে “সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পেশাই সেরা আর এই পেশাতেই সবচেয়ে বেশি প্যারা” এইটা আমার কাছে মনে হয় এবং মনে হওয়ার পিছনে অনেক কারনও আছে যা আজ একে একে বলার চেষ্টা করবো।
হয়তো সবার কাছে তা মনে হতে পারে, আমি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পেশায় আছি তাই নিজের পেশাকে সবচেয়ে সেরা বলছি বা তা প্রমান করতে চাইছি। কিন্তু না, এইটা বলার পিছনে অনেক আপেক্ষিকতা আছে।
সারাবিশ্বে অধিকাংশ পেশা থেকে এই পেশায় বেতন বেশি এবং এর চাহিদাও বেশি। বেতন বেশি হল একটি পেশা সেরা হওয়ার জন্য প্রাথমিক কারন। কিন্তু এই পেশায় বেতন বেশির জন্যই সেরা তা আমি বলতে চাচ্ছি না বরং বেতন ছাড়া অন্যান্য যেসব কারনের জন্য সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পেশা সেরা বলে বিবেচনা করা যেতে পারে তার কয়েকটি নিম্নরুপঃ
প্রথম ও প্রধান কারন হল এই পেশাটা সবচেয়ে বেশি সৃষ্টিশীল। গান, কবিতা, উপন্যাস বা সিনেমার মত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পেশায় পুনরাবৃত্তি কাজ খুবই কম। এখানে এক জিনিস একবার তৈরি করলে আর কাউকে আবার সেই একই জিনিস তৈরি করতে হয় না। তৈরি করলেও আগেরটি চেয়ে অনেক অগ্রগামি অনেক নতুন কিছু তৈরি করে। যেমন জাকারবার্গ ফেইসবুক বানাইছে তাই দুনিয়ার সবাই মিলে আরেকটি ফেইসবুক বানালেও চলবে না। তবে এর চেয়ে ভালো কিছু এবং ভিন্ন কিছু বানালে সেটা চলতে পারে। এইটা টেকনোলজির ক্ষেত্রে আরো বেশি হয়। তাই যারা এই পেশায় আছে, তারা আজ একটা জিনিস তৈরি করলে কাল নতুন কিছু তৈরি করতে হয়।
সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পেশার মুল কাজ হল অন্য পেশার কর্ম পদ্ধতিকে ডিজিটাইজের মাধ্যমে আগের চেয়ে ভালো সমাধান করা। তাই এই পেশায় কাজ করার ধরুন আর বাকি যা পেশা আছে সব কিছু সম্পর্কেই সময় সময় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে জানতে হয়। এমন কি, সফটওয়্যার নির্মান কোম্পানিতে যারা কাজ করে তাদের মাঝেও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারা একটা বিসিনেস সম্পর্কে বেশি জানতে হয়। সফটওয়্যার নির্মানে বড় দাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
আর ১০-১২ বছর ধরে একজন এই পেশায় কাজ করলে একদিন সেই মোটামোটি অন্যান্য পেশাতে কে কি করে, কোণ পেশার কি ধরন, কি পদ্ধিতে কাজ করে সেই সম্পর্কে ভালো একটা ধারনা হয়ে যায়। যেমন কেউ যদি এইচ আর এম নিয়ে কাজ করে, তাহলে বলা যায় যে, একটা অরগানাইজেশানের এইচ আর প্রশাসনিক দপ্তরে সেই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার প্রাথমিক কাজ কর্ম করতে সক্ষম হবে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পেশায় কাজ করলে, কিভাবে অন্য পেশা সম্পর্কে ধারনা হয় আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তার একটা নমুনা পেতে পারেন। তার জন্য আমার অন্য একটি লেখা "অন্যান্য পেশার ডোমেইন সংক্রান্ত আমার অভিজ্ঞতার একটা বিশ্লেষণ" দেখে আসতে পারেন।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আউটসোর্স করার সুযোগ রয়েছে এই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পেশায়। করোনা আসার আগেও ছিলো কিন্তু করোনার আসার পর, আরো বেশি করে এই পেশায় ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ করে দিছে। করোনার সময় লকডাউনের সময় সবপেশার লোক ঘরে বেকার বসে থাকলেও, একমাত্র এই পেশার লোকেরাই কাজ করে গেছে আর তাদের বেতন বা চাকরিরও তেমন সম্যসা হয় নাই।
বর্তমানে নতুন ব্যবসা বা নতুন আবিষ্কারে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পেশাই প্রথম জরিত থাকছে। বর্তমানে অধিকাংশ স্টার্ট আপ হয় টেকনোলজি নির্ভর যেখানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আবশ্যক। আর সেসব স্টার্ট আপ টেকনোলজি নির্ভর না, সেখানেও তাদের কার্যপ্রনালী ও মার্কেটিং এর জন্য বিভন্ন অটোমেশন সিস্টেম লাগে, যা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে শুরু করতে হয়। পৃথিবীতে কৃষি কাজ থেকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন পর্যন্ত নতুন যা কিছু হচ্ছে, বলা যায় তার বেশির ভাগই এই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পেশার মাধ্যমে হচ্ছে বা এদের সহায়তাই হচ্ছে।
একটু ভাবেন, হঠাৎ আপনার ঘরের বিদ্যুৎ চলে গেছে। লাইট ফেন বন্ধ হয়ে গেল। আপনি আপনার অফিসে, বাসা থেকে ফোন, বিদ্যুৎ চলে গেছে। আপনার মোবাইল থেকে ১ মিনিটে আপনি বিদ্যুৎ এর জন্য টাকা রিচার্জ করলেন। আপনার ঘরের লাইট ফ্যান চলতে শুরু করলো। আপনার ১ মিনিট সময়ে ঘরে বিদ্যুৎ আসার জন্য যে টেকনোলজিস ইকোসিস্টেম এবং বিদ্যূতের গ্রিড লাইন সেন্টারের ড্রীস্ট্রিবিউশনের যে সফটওয়্যার তা একজন প্রোগ্রামার ই করেছে। এক একটা কোড অথবা সফটওয়্যার সাধারণ মানুষের অনেক সমস্যা নিমেষে সমাধান করে দেয়। আজ আপনে ফেসবুক, ই-মেইল, ই-কমার্স সহ যত অনলাইন বা অফলাইন অ্যাপ্লিকেশানশ ব্যবহার করছেন অথবা হাসপাতাল, ফ্যাক্টরি, গার্মেন্টস বা এয়ারপোর্টে যে সব অটোমেটেড মেশিন চলছে তার কোড কোন এক প্রোগ্রামারের লেখা। এইভাবে আজকে বাসা থেকে অফিস বা এয়ারপোর্ট, এয়ারপোর্ট থেকে অন্য দেশ বা মহাকাশ স্টেশনে যত আরাম-আয়েশ এবং প্রয়োজনীয় জিনিষ তার পিছনে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ অবদান রয়েছে কোন না কোন প্রোগ্রামারের।
সব পেশার লোকদের কাজ হল সমস্যা সমাধান করা। অধিকাংশ পেশার লোকদের কাছে মানুষ যায় কোন না কোন সমস্যায় পরে যেমন অসুস্থ হলে মানুষ ডাক্তারের কাছে যায়, জমিজমা বা মামলার সমস্যায় মানুষ উকিলে কাছে যায়, সমাজের কোন দুর্ঘটনা বা সমস্য তৈরি হলে সাংবাদিক সংবাদ আকারে তা তুলে ধরে, আর্মি, পুলিশ,CID, বিডিয়ার, রেপ,আনসার বাহিনী, গোয়েন্দা, নৌবাহিনী,বিমান বাহিনী, বডার গাড এসব পেশায় সবাই সমস্যা হওয়ার পর সেইটা সমাধানের চেষ্টা করে। এইভাবে অধিকাংশ পেশাই সমস্যা হওয়ার পর কাজ করে আর সমাজ যা আছে তার থেকে আরও ভালো কিছু করার ক্ষেত্রে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পেশা কাজ করে।
বাংলাদেশের বর্তমানে সব পেশাই চাকরি পেতে মামা খালু বা ঘুষ লাগে। এইটা এখন সবাই জানে। কিন্তু একমাত্র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পেশায় মামা খালু বা ঘুষ এর দরকার হয় না। এমন কি অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ সনদ দিতে হয় না। শুধু অভিজ্ঞতা আর দক্ষতা হলেই চাকরি পাওয়া যায়।
এবার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পেশায় কেন এতো প্যারা, তার কিছু বাস্তবতা কয়েকটি পয়েন্ট এর মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। অধিকাংশ পেশা থেকে এই পেশায় বেশি স্ট্রেস নিতে হয়। লাইভ একটা সিস্টেমের একটা সমস্যার সমাধান না হওয়ায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে চেষ্টা করা যে কতটা স্ট্রেস নিতে হয় তা একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারই বলতে পারবে। বেশি স্ট্রেস নেওয়া প্যারাদায়ক পেশার জন্য একটি প্রাথমিক কারন তাই বেশি বেতনের মত বেশি স্ট্রেস নেওয়া ছাড়া এই পেশায় অন্যান্য আরও যে সব প্যারা আছে সেগুলো হলঃ
প্রথম প্যারা হল এই পেশা সবচেয়ে বেশি পরিবর্তনশীল। দিন দিন এই পেশা জিওম্যান্ট্রিক হারে পরিবর্তন হচ্ছে। আর এই পরিবর্তন এর সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে প্রতিদিন ই নতুন নতুন কিছু শিখতে হয়। আবার পুরানো জিনিসের নিয়মিত আপডেট করতে হয়। সারাজীবন পড়ালেখা করার পর চাকরী জীবনে সবসময় লেখাপড়া করা নিজের কাছে যেমন প্যারা, তেমনি পরিবারও সেটা ভালো চোখে দেখে না। পরিবার চায়, অফিসের পর পরিবারের সদস্যকে সময় দিবে।
দ্বিতীয় প্যারা হলো এই পেশায় কাজ করতে গিয়ে অন্যন্য পেশার অনেক ডোমেইন নিয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা করতে হয়ে। যেমন আমি যখন একাউন্টিং সিস্টেম নিয়ে কাজ করি তখন আমাকে একাউন্ট এর অনেক কিছু নিয়ে যেমন চার্ট অফ একাউন্টটিং, এস্সেটস, লিয়াবিলিটিজ, ভাউচার, একাউন্টস পেয়েবল, একাউন্টস রেসেইভাবেল, জার্নাল, জেনারেল লেজার, ট্রায়াল ব্যালান্স, ব্যালান্স শিট ইত্যাদি নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছে। আবার যখন এইচ আর ও পেরুল নিয়ে কাজ করি তখন আমাকে একজন কর্মচারীর নিয়োগ থেকে শুরু করে তার ছারপত্র পর্যন্ত সমস্ত প্রশাসনিক কার্যক্রম জানতে হয়েছে।
তৃতীয়ত, এই পেশায় থাকলে অফিসের সময় আর বাসার সময় আলেদা করা যায় না। মাথায় কোণ সম্যসার বিষয় একবার টুকলে তা সকাল নাই বিকাল নাই এমন কি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পরও সেই চিন্তা মাথায় গুরপাক খেতে থাকে। এমনকি অনেক সময় নামাজেও ঠিকমত মনযোগ দেওয়া যায় না।
চতুর্থত, এই পেশায় সবসময় বসে বসে কম্পিউটারে একাধারে চেয়ে থেকে কাজ করার ধরুন চোখের সম্যসা ও কোমরের ব্যথা সহ শরীরে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। যার ফলে জীবনের শেষের দিকে খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হয়।
সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পেশা সবচেয়ে বেশি পরিবর্তনশীল এবং সব সময় নতুন কিছু শিখতে হয় তাই অফিসের সময় পরও একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে বাসায় সময় দিতে হয়। তাই অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের যথেষ্ট সময় দেওয়া যায় না। পরিবারের সদস্যরা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদেরকে অনেক সময় বুঝতেই পারে না যে তারা সারাদিন কম্পিউটার এর সামনে বসে কি করে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের অনেকে খুব বোরিং পার্সন মনে করেন এবং অনেকে তাদের পাগল নামে খেতাব দিয়ে থাকে। আর এতে অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের সাথে মন মালিন্য হতে পারে।
শেষ প্যারাটা হল - বেশি অভিজ্ঞতা। যেহেতু সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার একটা সৃষ্টিশীল পেশা, তাই সে যত কাজ করে তত নতুন নতুন কাজ শিখে এবং এভাবে সে বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ হয়ে যায়। আর সেই অনুযায়ী তার প্রত্যশাও বেড়ে যায়। কিন্তু অরগানাইজেশনের হাই ম্যানেজমেন্ট অনেক সময় সেই অভিজ্ঞতার মূল্য দেয় না বা অনেক সময় অন্য কর্মকর্তার সাথে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কর্মকর্তার তুলনা করে ফেলে তার প্রাপ্য দিতে চায় না। তখন সে ঐ অরগানাইজেশনে থাকলে মনে মনে প্যারা খায় আবার অরগানাইজেশন পরিবর্তন করেও অনেক সময় ভালো অরগানাইজেশন না পেয়ে প্যারা খেতে হয়।
শেষের কথা
চিত্রাঙ্কন, ভাস্কর্য, ফটোগ্রাফি, গান, লেখা, কবিতা ইত্যাদির মত সফটওয়্যার তৈরি করা একটি শিল্প। শিল্পী হওয়ার ধৈর্য এবং মেধা সকলের থাকে না আর কেউ কাউকে শিল্পী হতে শেখাতে পারেন না যদি না সে নিজের থেকে শিল্পী হতে চায়। শিল্পী হতে চাইলে আপনার অবশ্যই মেধা এবং প্রয়োজনীয় আবেগ থাকতে হবে। একইভাবে, সফ্টওয়্যার তৈরিতেও আপনার সফ্টওয়্যার তৈরি করার মেধা এবং আবেগ থাকতে হবে। আপনার যতক্ষণ আগ্রহ ও আবেগ থাকবে, সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পেশা আপনার কাছে সেরা মনে হবে আর যখন থাকবে না, তখন শুধু প্যারাই মনে হবে।
--------------- ********* ---------------